শুধু নিয়ম করে শুনি তাই-ই নয়, বাড়ির সকলে একসঙ্গে সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে রেডিয়োও মহিষাসুরমর্দিনী শোনা হয়। এই অভ্যাস ঠাকুর্দার আমলে তৈরি হয়েছিল। নয়-দশ বছর বয়সে ঠাকুর্দার সঙ্গেই মহিষাসুরমর্দিনী শোনা শুরু হয়েছিল। অভ্যাসটা আজও একই আছে। আর এখন তো রেডিয়ো জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই কোনওভাবেই মিস করি না।
এখন ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনও প্রস্তুতি থাকে না। তবে আমার বাড়িতেও একটা বড় রেডিয়ো ছিল, নীল রঙের। তার আবার একটা সাদা লেসের ঢাকনাও ছিল। মহালয়ার আগে যে শুধু রেডিয়ো ঝাড়ামোছা হতো তা-ই নয়, ওই লেসের ঢাকনারও যত্নআত্তি হতো। তবে এখন আর রেডিয়োটা নেই। কিন্তু মহিষারসুরমর্দিনী শোনার টানটা একইরকম রয়ে গিয়েছে। আগের রাত থেকে বেশ একটা উত্তেজনা হয়। এত বছর ধরে এত বার শুনেছি, প্রায় অনেক সিক্যুয়েন্সই ঠোঁটস্থ, তবু প্রত্যেকবার নতুন লাগে।
পুরনো বড় রেডিয়ো নেই। তবে এখন আধুনিক রেডিয়ো হয়েছে, যেগুলো বৈদ্যুতিন। সেখানেই শুনি। মোবাইলে শুনে মজা পাই না। সামনে একটা রেডিয়ো সেট থাকতেই হবে।
২৭ বছর ধরে রেডিয়ো করছি। এই দীর্ঘ সময়ে বহুবার রেডিয়ো জকি হিসেবে মহিষারসুরমর্দিনী শোনা হয়েছে। নেপথ্যে যে কাহিনীগুলো রয়েছে, সেগুলো লোকমুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সত্যি সত্যিই বাঙালি জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শুধু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই নন, বাণী কুমার এবং পঙ্কজ মল্লিক, মানে এই ট্রায়ো… তাঁদের কীর্তি অবিস্মরণীয়, রেডিয়ো জগতে ওঁদের কন্ট্রিবিউশন, আনম্যাচড। আর কেউ করে উঠতে পারবেন না।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ওই চণ্ডীপাঠটা যখন শুনি মনে হয় ঘরের মধ্যে অজস্র ধূপ জ্বলে উঠেছে। এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। সকালবেলায় এই যে পরিবেশটা তৈরি হয়, আমি কল্পনার ভাষায় এটা বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। ভোরবেলায় তখন পাখিদেরও বোধহয় ঠিক করে ঘুম ভাঙেনি। এ দিকে, গমগম করছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর। পাড়ার প্রায় সব বাড়ি থেকে ভেসে আসছে একটাই সুর। গোটা পাড়া মুখরিত। এ এক অদ্ভুত মুগ্ধতা।
সবচেয়ে মজার হল ওঁর জন্মদিন কখনও ভুলব না। ৪ঠা অগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্মদিন। ওই একইদিনে কিশোর কুমারেরও জন্মদিন। বাঙালি যেভাবে হইহই করে কিশোর কুমারের জন্মদিন পালন করে, বোধহয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্মদিনটাও পালন করা উচিত। কিন্তু অনেকে হয়তো তাঁর জন্মদিন কবে, সেটা জানেনই না।
আমার বেড়ে ওঠা রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড, ওয়েলসলি রোড, রিপন স্ট্রিট অঞ্চলে… একদম কসমোপলিটান এলাকায়। যে পাড়ায় প্রথমে থাকতাম সেখানে বাঙালি বাড়িই দু’-তিনটে, একেবারে হাতেগোনা। আর তাঁরা অ-হিন্দু পরিবার। ফলে তাঁদের বাড়িতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার চল ছিল না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে শোনা হত। এর জন্য আব্বা আর মায়ের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ ওঁরা মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে খুব ভালবাসেন। সেই সময় সকাল-সকাল উঠে পড়তেন, রেডিয়ো চালাতেন। আমারও ঘুম ভেঙে যেত। ধন্যবাদ ওঁদের যে ধর্মের বেড়াজালে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার ব্যাপারটাকে বেঁধে রাখেননি। ঠাকুর্দার পর আব্বা-মায়ের সঙ্গেই মহিষাসুরমর্দিনী শুনে বড় হয়েছি।
আসলে তখন তো রেকর্ডেড ভার্সানের সেভাবে চল ছিল না। তাই একটা গোটা বছরের অপেক্ষা। তবেই শোনা যাবে মহিষাসুরমর্দিনী। সেজন্য মিস হলে হাত কামড়াতাম। মিস অবশ্য প্রায় হয়নি বললেই চলে। অনেকে ছোটবেলায় বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী শোনো!’। এখনও অনেকে বলে ফেলেন ‘মহালয়া শুনবে তো’। আসলে মহালয়া কেউ শোনে না। মহালয়ার সকালে মহিষাসুরমর্দিনী শোনে। এরকম সিনট্যাক্স এরর আমাদের হয়।
আর আমার জীবনে মহিষাসুরমর্দিনী রেডিয়োর সবচেয়ে জনপ্রিয় শো। এমন একটা বেতার অনুষ্ঠান যা সব ধর্মের মানুষকে একসঙ্গে বাঁধে, ভোরবেলায় রেডিয়োর সামনে বসিয়ে দেয়। এমন নজির কিন্তু নেই।
মহালয়া মানেই মহিষাসুরমর্দিনী আর রেডিয়ো। এই রেডিয়ো কিন্তু ঠিক রাখতেই হবে। এই প্রসঙ্গেই একটা ঘটনা আছে। মধ্যবিত্ত বাড়িতে রেডিয়োর ব্যাটারি প্রায় শেষ হয়ে এলেও দু’-চারটে চড়-থাপ্পড় মেরে ফের সেটা চালু করার একটা প্রবণতা রয়েছে। মানে যতক্ষণ ব্যাটারি চলে আরকি। আমি ছোটবেলায় একবার রেডিয়োর ব্যাটারি পাল্টাতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই নিয়ে আব্বা খুব বকাবকি করেছিলেন। মহালয়ার আগের রাতে আব্বা আমায় মনে করানো সত্ত্বেও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। বাড়িতে বাড়তি ব্যাটারি ছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা আলমারি থেকে বের করে রেডিয়োতে লাগাতে গিয়ে মহিষাসুরমর্দিনীর খানিকটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। এই নিয়ে আব্বার কাছে প্রচুর বকা খেয়েছিলাম সে দিন। এটা আজও মনে আছে।
আগে রিঅ্যাক্ট করে ফেলতাম। রাগ হত। ভীষণ… ভীষণ রাগ হত। এখন রিঅ্যাক্ট করি না। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সবাইকে, বিশেষত যাঁরা পাবলিক ডোমেইনে কাজ করি, তাঁদের একটা নীতি মেনে চলতে হয়। এই সমস্ত নেগেটিভ কমেন্টকে যত পাত্তা দেব, ততই নেগেটিভিটি ছড়াবে। তাই ওটাকে পাত্তা দিই না। জানি যেটা করছি, সেটা ঠিক। এই ধর্মের নাম করে কত মানুষ কত ভণ্ডামি করে বেড়ায়…
এরকমও শুনেছি যে আমি এমন একটা দেশের নাগরিক, যেখানে মুসলমানরা মাইনরিটি। আর তাই মেজরিটিদের তোষামোদ করতেই নাকি আমি মাঝেমাঝে অন্য ধর্মের উৎসব নিয়ে মাতামাতি করি। এইসব ভিত্তিহীন কথাবার্তাও শুনেছি। এখন আর কিছুতেই কিচ্ছু যায় আসে না। যারা এতদিনে বোঝেনি, তারা কোনওদিন বুঝবে না। এটা মাথায় রেখেই এগিয়ে যাওয়া।
বাঙালিকে বাঙালিরাই সবচেয়ে বেশি হ্যাটা করে। এতে নতুন কিছু নেই। আমরা একে-অন্যকে কাঁকড়ার জাত বলি। আমরা মনে-মনে এটা বিশ্বাস করি। কাজেও করে দেখাই। একজন বাঙালি আর একজনের ভাল দেখতে পারে না। কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করে। মাঝেমধ্যে কষ্ট হয় যে, তাহলে ধর্মই সব। কাজ দিয়ে কিছুই করতে পারিনি। তারপর নিজেকে বোঝাই যে কিছু অর্বাচীন লোককে এক্সপ্ল্যানেশন দেওয়ার কোনও মানে হয় না। তাই আজকাল আর পাত্তা দিই না।
আমরা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু এই নিরপেক্ষ থাকায় অনেকেরই আপত্তি রয়েছে। অনেকেই নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। একটা না একটা পক্ষ বেছেই নেন। যাক গে, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আগেও যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসব পালন করতাম, এবারও সেভাবেই করব। আগামী দিনেও করব।
কোভিডের জন্য এমনিতেই মানুষের জীবন থেকে ‘উৎসব’ বিষয়টা উঠে গেছে। তাই যেটুকু হাতের কাছে পাই, চেটেপুটে খাই।
আরও পড়ুন- হয়তো নিজে থেকে পুরনো অভ্যাস ফেরাতে না চাইলে কেউ নতুন করে আর চিঠি লিখবেন না: মীর আফসার আলি
গ্র্যাফিক্স ও অলংকরণ- অভীক দেবনাথ