আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে…
কিশোর রবীন্দ্রনাথের লেখা ওই পংক্তিগুলি একবিংশ শতকে এসেও চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে বেশ কয়েকটি সিনেমাটিক দৃশ্য…শুধু উদরপূর্তি নয়, খাদ্যগ্রহণও যে এক প্রকারের নিখুঁত শিল্প তা যেন টের পাইয়ে দেয় অজান্তেই… এক ঝটকায় নিয়ে চলে যায় মধ্য কলকাতার ওই বিশাল বাড়িটির অন্দরমহলে। খাওয়ার পাতে হাপুস হুপুস শব্দ আর আম-কলা দিয়ে মাখা দুধের মহিমা ওই ছোট বয়সেই ঠাওর করতে পেরেছিলেন বাঙালির ঠাকুর। ভোজনরসিক না হলে এমন সাধ্যি কার?
রবীন্দ্রনাথ খেতে ভালবাসতেন, তবে খুব যে বেশি খেতেন এ প্রমাণ মেলেনি। ঠাকুরবাড়ির অন্দরের রান্না নিয়ে আস্ত বই আছে। সহজপাঠ ঘাঁটলেও তাতে দেখা মিলবে খাবারের গুচ্ছ উপমা। আবার দামোদর শেঠের মতো ‘গরীবের রক্ত’ পিয়াসী মানুষও তাঁর যে ছিল বেজায় নাপসন্দ সে উদাহরণও পাওয়া গিয়েছে তাঁর লেখায়। কেমন রান্না পছন্দ ছিল কবিগুরুর? কী খেতে ভালবাসতেন তিনি… সে উদাহরণ পাওয়া যায় রবি-ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজনের লেখনীতে।
রকমারি রান্না পছন্দ ছিল তাঁর। ভালবাসতেন খাওয়াতেও, সে প্রমাণ মিলেছে বনফুলের লেখায়। বিহারের ভাগলপুরের থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। কবির জন্য সন্দেশ নিয়ে গিয়েছিলেন লেখক। প্রণাম ও প্রাথমিক সম্ভাষণের পর সন্দেশ মুখে দিয়েই বিমোহিত ঠাকুর। সন্দেশ খেতে খেতে বললেন, ‘বাংলাদেশে তো দুটি মাত্র রস-স্রষ্টা আছে। প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ যে তৃতীয় লোকের আবির্ভাব হল দেখছি।’ খাদ্যরস, কাব্যরস ও হাস্যরস– তিন রসের অপূর্ব মিলন ঘটেছিল সে দিন, প্রমাণ সাহিত্যিক বনফুল। তবে শুধু খেয়ে তারিফই নয়, খাওয়াতে ভালবাসতেন।
তাঁর শৌখিনতার ছাপের কিছু বিবরণ মিলেছে ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও বনফুলের লেখাতেও। রথীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন খাবার পাত্র, ঘর সাজানো থেকে শুরু করে পরিবেশনের প্রণালী ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপারে নিখুঁত নজর ছিল তাঁর। বনফুলের লেখায় পাওয়া গিয়েছে, উত্তরায়ণে এক বারান্দাকে পর্দা দিয়ে ঘিরে তাতে বনফুল ও তাঁর পরিবারের জন্য খাবারের আয়োজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রকমারি পদ নয়, পরিবারের প্রত্যেকের জন্য ব্যবস্থা হয়েছিল ভিন্ন টেবিলের। প্রত্যেক টেবিলে ছিল বেশ কয়েকটি থাক, সে থাকে সারি দিয়ে খাবার সাজানো। তাঁর শৌখিনতার ছাপ ছিল প্রতি পদে…
স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর কাছে তাঁর যত ছিল অদ্ভুত রান্নার আবদার। আবদার করেছিলেন মানকচুর জিলাপি খাবেন। স্বামীর সে আবদার রেখেছিলেন স্ত্রী। দইয়ের মালপো, পাকা আম দিয়ে তৈরী মিষ্টি… কবির এ সবের চাহিদা মেটাতেন স্ত্রীই। মৃণালিনী দেবী একবার এক মিষ্টি বানিয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, ‘এলোঝেলো’। খানিক গজার মতো সুস্বাদু ওই মিষ্টির ‘এলোঝেলো’ নাম মনে ধরেনি কবিগুরুর। নাম বদলে তিনি রাখলেন পরিবন্ধ। খাদ্যরসের সঙ্গে মিলল সৃষ্টিশীল মনন, যার প্রতিফলন ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘরেও দেখা গিয়েছে প্রায়শই।
তাঁর খাবার-প্রীতির অনুরাগ পাওয়া যায় সহজ পাঠেও… শিক্ষার শুরু হোক খাবারের সঙ্গে মিল রেখেই– এমন ভাবনাই কি ছিল বিশ্বকবির মাথায়? দ্বিতীয় পাঠে কবি লিখেছেন,
“থালা ভরা কৈ মাছ, বাটা মাছ। সরা ভরা চিনি ছানা। গাড়ি গাড়ি আসে শাক লাউ আলু কলা। ভারী আনে ঘড়া ঘড়া জল। মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা। রাতে হবে আলো। লাল বাতি। নীল বাতি। কত লোক খাবে।”
মধ্যরাতে লালবাতি-নীলবাতি প্রায়শই জ্বলে উঠত অন্দরমহলে। উনুনে পড়ত আঁচ। মধ্যরাতে সভায় রবির ইচ্ছে জাগত খাওয়ার। হালফিলের ভাষায় ‘ক্রেভিং’। তখন ভরসা সেই স্ত্রী। দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। কাবাবেও ছিল বেশ অনুরাগ। বিশেষ পছন্দ ছিল জাপানি চা। জাপান ভ্রমণের সময় তাঁর জন্য স্পেশ্যাল টি-সেরিমণির আয়োজন হত বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: Rabindranath Tagore : পরিচালক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম এবং একমাত্র সিনেমা…
খেতে ভালবাসতেন, খাওয়াতেও ভালবাসতেন… আর রান্না? তা কি করতে পারতেন? মংপুতে থাকাকালীন লেখক মৈত্রেয়ী দেবীর এক বিবরণ থেকে এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। এক বৈশাখী বিকেলে রবীন্দ্রনাথের শখ জাগে মারমালেড দিয়ে ছাতু মেখে সবাইকে খাওয়াবেন। পাহাড় ঘেরা মংপুরে খোঁজ মিলল না যবের ছাতুর। মুড়ির ছাতু দিতেই কাজ শুরু করলেন তিনি। মারমালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ কলা মাখন দিয়ে প্রায় আধঘন্টা ধরে ছাতু মাখলেন তিনি। তবে স্বাদ মোটেও রসনায় তৃপ্তি দেয়নি। রবিঠাকুর অবশ্য দোষ চাপিয়েছিলেন মুড়ির ছাতুর উপর। তবে দমে যাননি তিনি। পরদিন তাঁর নির্দেশে যব ভেজে গুঁড়ো করে ছাতু বানানো হল। আবার রবিঠাকুরের হাতে ছাতু মাখা। যদিও যে কেই সেই। ছাতুর পরিবর্তন হলেও স্বাদের বিশেষ হেরফের হয়নি।
প্রতি সকালে নিমপাতার রস খেতেন তিনি। খাবারের ভাগও ছিল পরিমিতি। তবে তিনি ছিলে খাদ্যবিলাসী এক প্রাণ, যিনি লিখেছিলেন,
“হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ
বসে খায় ক্ষীর খই”,
“বাটি হাতে এ ঐ
হাঁক দেয় দে দৈ”
“ডাক পাড়ে ও ঔ
ভাত আনো বড় বৌ”,
“ত থ দ ধ বলে, ভাই
আম পাড়ি চল যাই”।
তথ্য ঋণঃ মংপুতে রবীন্দ্রনাথ- মৈত্রেয়ী দেবী
ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব
নেটমাধ্যম ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা