জীবিত অবস্থায় কোভিড মুক্ত পৃথিবী দেখে যেতে চেয়েছিলেন মানুষটি। সেই কোভিডই কেড়ে নিল তাঁকে। আজ এক মন খারাপের দিন। প্রয়াত লতা মঙ্গেশকর। ৩৩ বছর বয়সে নিভৃত বিষক্রিয়াও যে মানুষটিকে কেড়ে নিতে পারেনি, কোভিড-নিউমোনিয়ার জোড়া ধাক্কা আর সামলাতে পারল না ৯২-এর শরীরখানা।
মৃত্যুকে ভয় পেতেন লতা
অথচ মৃত্যুকে বড় ভয় পেতেন লতা। মৃতদেহের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রক্তচাপ বেড়ে যেত কয়েক গুণ। অতীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “চোখের সামনে মৃত্যু দেখলেই আমার প্রেশার বেড়ে যায়। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছেন বাড়ি বসে দুঃখ করুন। মৃতদেহের কাছে যাবেন না।” ধর্ম বলে, আত্মা নাকি অবিনশ্বর? তবে? শেষের কয়দিনও চিকিৎসককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁকে নিয়ে অকারণ হইচই যেন না হয়। অসুস্থতার খবর ছড়াতেই দেশ-বিদেশে শুরু হয়েছিল যজ্ঞ। নিজের বাড়িও বাদ যায়নি। তবু, চলে গেলেন তিনি…। বাগদেবীর মানবী রূপের প্রয়াণ হল নিভৃতেই। এমনটাই তো চেয়েছিলেন আজীবন। অনাড়ম্বর জীবন বেছেছিলেন স্বইচ্ছায়। নিজেকে বেঁধে রাখতেন কঠোর অনুশাসনের মধ্যে। সঙ্গীত জগতের বাইশ গজেও তাই হয়তো ব্যাট চালাতে পেরেছেন অনায়াস। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে বারেবারেই বলতেন শিকড়ের কথা, শিকড় না ভোলার কথা।
বাঙালিই ‘কাঁকড়ার জাত’?
মধ্যবিত্ত পরিবারে সব ভাই বোনদের মধ্যে লতাই ছিলেন বড়। জন্মপত্রে লতার নাম ছিল হেমা। পরবর্তীতে বাবার এক নাটকের চরিত্র লতিকার নামানুসারে বদলে যায় হেমার নাম। আত্মপ্রকাশ ঘটে লতা মঙ্গেশকরের। মাত্র ১৩ বছর বয়সে গানের কেরিয়ার শুরু। সাল, ১৯৪২। লতা যখন স্টুডিয়োতে গান গাইয়েছে, সেই বছরেই জন্ম হচ্ছে অমিতাভ বচ্চনের।
দু’হাত বাড়িয়ে মুম্বই লতাকে গ্রহণ করেননি প্রথমে। প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় তাঁর শহীদ ছবিতে গান গাওয়ার ইচ্ছে বাতিল করে দিয়েছিলেন নিমেষেই। লতার গলা পাতলা, মন্তব্য ছিল তাঁর। সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার অবশ্য সেদিন বেশ কটি কথা শুনিয়ে এসেছিলেন শশধরকে। জোর গলায় বলেছিলেন, “প্রযোজকরা এর পর লতার পা ধরে তাঁদের ছবিতে গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবে।” এক বাঙালি খারিজ করেছিলেন লতার গান আর পরবর্তীতে বাঙালিদের হাত ধরেই লতা ‘ব্র্যান্ডের’ ঘটেছিল আত্মপ্রকাশ। বাংলা জানতেন, বলতেও পারতেন। তাঁর ‘রঙ্গিলা বাঁশি’র সুরেলা গলা একটা গোটা প্রজন্মকে প্রেমে পরতে শিখিয়েছিল। জীবনের এপিটাফে রোম্যান্টিজিমের কাব্য রচনা করেছিলেন তিনি। আর বিতর্ক? তাও কি দূরে ছিল তাঁর থেকে?
আশা প্রতিযোগী!
বোন আশার সঙ্গে তাঁর প্রতিযোগিতা নিয়ে বারেবারেই সরব হয়েছে দেশি-বিদেশি মিডিয়া। লতা অবশ্য শেষদিনেও বলেছেন, “আশা নিজের মতো গেয়েছিল বলেই আমায় ছায়া হয়ে থাকেনি।” রানু মন্ডলকে নিয়ে মাতামাতিতে শেষবয়সেও যেমন অসন্তুষ্ট হয়েছেন লতা আবার ঠিক তেমনি কলকাতা সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে মোজারটের সিম্ফনি শুনে প্রাণখোলা প্রশংসাতেও ভরিয়ে দিয়েছেন অনায়াসে। অথচ তাঁর ‘অবসর’ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বিরাট কোহলি তিনি হতেই পারতেন, কিন্তু তিন সেই পথ বেছে নেননি। করতে চেয়েছিলেন কাজ।
বছর কয়েক আগেও তাঁর বাংলা গান রেকর্ড করেছেন লতা। ১৩ বছরের মেয়ে যে অনুশীলন, স্বশ্বাসন আয়ত্ত করেছিল তিলে তিলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সেই নিয়মই লালন করেছেন তিনি। ‘লতা মঙ্গেশকর মিউজিক কোম্পানি’র অধিকর্তা, সুরকার ময়ূরেশ পাই একবার এক সাক্ষাৎকারে সেই বাংলা গান রেকর্ডের দিন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “লতাজিকে বলেছিলাম, আপনি লাঞ্চ করে নিন, তারপর আমরা কারেকশনগুলো ঠিক করে নেব।’’ শুনে বললেন, ‘‘যে দিন রেকর্ডিং থাকে আমি তো সে দিন কিছু খাই না। ভরপেটে রেকর্ডিং হয় নাকি! স্রেফ চায়ে পিতি হুঁ। তুমি আমার জন্য পারলে আধ বাটি স্যুপ আনিয়ে দাও।’’দীর্ঘ কেরিয়ারে দেরি করে সেটে আসা ছিল অপছন্দের।
লতা কি ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’?
গানের রয়্যালটি নিয়ে হয়েছিলেন সরব। অথচ ডিপ্লোম্যাটিক আখ্যাও বয়ে বেড়াতে হয়েছে আজীবন। সত্যিই কি তিনি পলিটিক্যালি কারেক্ট ছিলেন লতা? ঘনিষ্ঠরা বলে, নিভৃত জীবন বেছে নিলেও সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে ৯২-তেও ওয়াকিবহাল ছিলেন লতা। প্লে ব্যাক সিঙ্গিংয়ে বর্তমান সময়ে এক্সেলেন্সের পরম্পরার ধরে রাখতে না পারা নিয়েও হয়েছে সরব। আবার নিজের গান ১০০ বছর পরেও লোকের মনে থাকবে কিনা তা নিয়েও প্রকাশ করেছেন সন্দেহ। কেন? বলেছিলেন, ‘যুব সমাজের মনোযোগের স্থায়িত্ব এখন বড় কম’। অভিমান না চরম সত্য? নিভৃতে থেকেও নিভৃতে থাকেননি লতা। সঙ্গীত জগতের সুচিত্রা সেন চাইলে হতেই পারতেন তিনি, তবু শেষদিনেও সঙ্গীতকে আঁকড়েই বাঁচতে চেয়েছেন সুরসম্রাজ্ঞী। গত বছর জন্মদিনের আগেও সংবাদমাধ্যমকে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘আমার যে ৯২ হল মনেই হয় না’। একটা যুগ শেষ হল। কিন্তু ব্র্যান্ড রয়ে গেল অচিরেই। পঞ্চভূতে বিলীন হবে তাঁর নশ্বর দেহ। তিনি রয়ে গেলেন, বলে গেলেন…
‘লাগ যা গলে কে ফির ইয়ে হাসি রাত… হো না হো… শায়েদ ফির ইস জনম মে মুলাকাত হো না হো… ও ও…’