আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন তিনি। বিষয় মনোবিজ্ঞান। তাঁকে সাধারণ দর্শক মূলত চেনেন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই। তিনি অর্থাৎ সোমলতা আচার্য চৌধুরি। আশুতোষ কলেজের এই প্রাক্তনী গত ১৩ বছর ধরে নিজের কলেজেই শিক্ষকতা করছেন। ৫ সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবসে অনলাইন এবং অফলাইন ক্লাসের রোল কল করলেন। শিক্ষকতার শুরুর দিন থেকে ভার্চুয়াল ক্লাসের অনস্ক্রিন প্রেজেন্টেশনের অভিজ্ঞতার নোটস দিলেন তিনি…।
২০০৮ সাল থেকে পড়ানো শুরু করেছি আমি। ১৩ বছর হল। বাচ্চাদের পড়ানোর সুবিধে-অসুবিধে যেমন রয়েছে, তুলনায় বয়সে বড়দেরও ক্ষেত্রেও তাই-ই। তবে আমি ভার্চুয়ালি পড়ানো খুব একটা এনজয় করিনি। যেটা লাইভ শোয়ের ক্ষেত্রেও হয় আমাদের, ইনস্ট্যান্ট ফিডব্যাক পাওয়া যায়। পারফর্মাররা লাইভ ইভেন্ট যেমন মিস করেছি, লাইভ ক্লাসও তাই। সামনে ক্লাস নিলে কে শুনছে, কে বুঝছে সেটা বুঝতে পারি মুখ দেখে। ডিজিটালি সেটা সমস্যার। যেহেতু ফিজিক্যাল কানেকশন ফিল করা যায় না, সেটা বোঝা মুশকিল। স্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে কতটাই বা জানা বা বোঝা যায়? ডিজিটালেও প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু কখনও কানেকশনের ইস্যু থাকতে পারে। নেটওয়ার্ক ইস্যুতে কেউ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস মিস করে গেল…।
আমি যখন পড়ানো শুরু করলাম, প্রথম দিকে এক দু’মাস যাঁর কাছে পড়েছি, তেমন একজনকে সহকর্মী হিসেবেও পেয়েছিলাম। বাকি টিচাররা আমি যখন পড়াতে ঢুকেছি, তখন অন্যান্য জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। একজনই ছিলেন। কলিগ হিসেবে পেয়েছিলাম। অদ্ভুত লাগত আমার। ওই স্টাফ রুমেই এক সময় পারমিশন নিয়ে ঢুকতাম। সেই স্টাফ রুমেই একই বেঞ্চ শেয়ার করতাম পরে, অদ্ভুত লাগত। পরে উনিও অন্য জায়গায় চলে যান।
এখনকার বাচ্চারা সব দিক থেকেই ওয়াকিবহাল। টেকনোলজিক্যালি খুব সাউন্ড। তাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে গেলে আমাকেও পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হয়। আমি যখন স্টুডেন্ট ছিলাম, কিছু প্রশ্ন হয়তো মাথায় আসেনি, এখন আমার স্টুডেন্টরা সে সব প্রশ্ন করে। তার উত্তর দেওয়া একটা চ্যালেঞ্জ। শুরুর দিকে টেনশন থাকত, হঠাৎ কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারব কি না, ভাবতাম। তাই চর্চাটা রাখতেই হয়। রিসেন্ট সার্ভে, রিসার্চ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকি। নিজেকে কন্টিনিউয়াস গ্রোথের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া আর কি… প্রথম দিকে টেনশন থাকত ঠিকই, এখন ইউজড টু হয়ে গিয়েছি।
আমি যেহেতু মঞ্চে অনুষ্ঠান করি, সেটা আমার অন্য একটা সত্ত্বা। মঞ্চে পারফর্ম্যান্সের সময়—পড়ানোর শুরুর দিকের কথা বলছি—লাইভ অডিয়েন্সে কোনও অনুষ্ঠানে যদি স্টুডেন্টের মুখ দেখতে পেতাম, নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়তাম। ভাবতাম, আমাকে ওরা কলেজে একেবারে অন্যভাবে দেখে, স্টেজে অন্যরকম দেখছে। আমি এমব্যারাসড হয়ে যেতাম। সেটাতে এখন কমফর্টবেল হয়ে গিয়েছি।
আর একটা মজার সমস্যা প্রথম দিকে হত। আমি অনেক ছোট ছিলাম তখন। হয়তো সালোয়ার পরে কলেজে পড়াতে চলে গিয়েছি। স্টুডেন্টরা ভাবত আমিও স্টুডেন্ট। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হয়তো কেউ-কেউ ধাক্কা দিয়ে উঠে যেত। ইচ্ছে করে করত, এমন নয়। যা হয়… ওরা ভাবত আমিও বন্ধু, ধাক্কা লাগতেই পারে। তাই প্রথম দিকে কলেজে টানা কয়েক বছর শাড়ি পরে যেতাম।
টিচার হিসেবে আজ অবধি কউকে বকিনি আমি। পানিশমেন্টও দিইনি। কিন্তু সকলে তা-ও আমাকে সমীহ করে। আমি ক্লাস নিতে ঢুকি। হয়ে গেলে অ্যাটেনড্যান্স দিয়ে বেরিয়ে যাই। নো-ননসেন্স টাইপ টিচার। সে জন্য স্টুডেন্টরা কখনও অন্য রকম কথা বলার সাহসও পায়নি। আমাকে ইন্ডাস্ট্রিতেও স্নব ভাবে সবাই। প্রচুর অ্যাটিটিউড আছে ভাবে। রাগী ভাবে। স্টুডেন্টরাও হয়তো প্রথমে তাই-ই ভাবত। পরে যখন চিনে যায় আমাকে, একটু পুরনো হয়ে যাই, তখন নানা রকম আবদার করে। হয়তো ক্লাসের শেষে বলল, ‘ম্যাম, গান শোনান।’ অথবা ‘ম্যাম, আপনাকে ওখানে দেখলাম।’ এর বাইরে অন্য রকম কোনও কথা আমাকে মুখের উপর কেউ বলার সাহস পায়নি কোনওদিন।
ভার্চুয়াল ক্লাসে স্টুডেন্টদের কিছু দুষ্টুমির কথা আমি কলিগদের থেকে শুনেছি। আমার ক্লাসে এখনও পর্যন্ত হয়নি। হয়তো কোনও স্টুডেন্ট ভুল নাম দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। অথবা হঠাৎ করে কিছু লিখে দিচ্ছে। অনেকে হয়তো ভিডিয়ো অফ করে রাখছে। প্রথম দিকে স্টুডেন্টদের কাছেও অনলাইন ক্লাস নতুন বিষয় ছিল। সকলে ভিডিয়ো অন করে বসত। এখন নেটওয়ার্ক ইস্যু বলে ভিডিয়ো অফ করে চালিয়ে দিচ্ছে অনেকেই।
আমি আসলে যে বিষয়টা পড়াই সেটা প্র্যাকটিক্যাল ওরিয়েন্টেড। সেটা ডিজিটালি বোঝানো কঠিন। আমরা সকলেই চ্যালেঞ্জিং সিচুয়েশনে পড়েছি, তার মধ্যেও বেস্ট করা যায় কী ভাবে সেটা চেষ্টা করেছি। বেশি এফর্ট হয়তো দিয়েছি। নতুন অ্যাপ্রোচেস অব টিচিং নিয়ে ভেবেছি। অনলাইন ক্লাসের পজিটিভ দিকও রয়েছে। নর্মাল সিচুয়েশনে যত ওয়েবিনার করেছি আমরা, গত এক বছরে তার থেকে অনেক বেশি করার সুযোগ পেয়েছি। প্রায় ২০টা ওয়েবিনার করেছি। অফলাইনে এতটা হয় না। যাওয়া, থাকা-খাওয়ার কস্ট কাটিং হয়ে গিয়েছে। ফলে বেশি সংখ্যায় ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছি। অন্য দিকে, স্টুডেন্টরাও একটা অন্য ডাইমেনশন পেয়েছে। আর একটা এমন অনেক সিনিয়র টিচার আছেন, যাঁরা টেক স্যাভি ছিলেন না। ডিজিটাল ব্যাপারটা তাঁরাও নতুন করে শিখেছেন। আমিও শিখছি। টেকনিক্যাল আসপেক্টে নিজেদের গ্রুম করতে পেরেছি। এমনি সময়ে হয়তো সেটা সম্ভব হত না।
গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন, আমার আর কালিকাপ্রসাদের মধ্যে শিক্ষার আদান-প্রদান চলতেই থাকত…: ঋতচেতা গোস্বামী