বাঙালির কবি বলতে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে রবীন্দ্রনাথের নাম। আর তারপরই আসে কাজী নজরুল ইসলামের (Kazi Nazrul Islam) নাম। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁকে “বাংলার কবি, বাঙালি কবি” বলে অভিহিত করেন ১৯২৯ সালে। তৎকালীন কলকাতার অ্যালবার্ট হল বা বর্তমানের কফি হাউসে নজরুলকে জাতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে আচার্য রায় তাঁকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও। তিনি সেদিন বলেছিলেন, “আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।”
বাংলাদেশের বিখ্যাত দৈনিক ‘প্রথম আলো’ লিখছে, “বিদ্রোহী কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামের আত্মজাগরণ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মপ্রত্যয় প্রতিষ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে তিনি বহুমাত্রিক রূপে প্রকাশমান। এ কবিতায় তিনি সব ধ্বংসকারী আবার স্রষ্টা; তিনি বিপ্লবী আবার প্রেমিকও; তিনি সর্বাংশে স্বদেশি আবার বিশেষভাবে আন্তর্জাতিকও; প্রচণ্ড আধ্যাত্মিক আবার ব্যাপকভাবে ইহজাগতিকও; এখানে নজরুল যেমন ভারতীয় পৌরাণিক দেবদেবীকে স্থান দিয়েছেন, তেমনি মুসলিম পুরাণের অনুষঙ্গও এনেছেন। যে প্রসঙ্গগুলো উত্থাপিত হলো, প্রিয় পাঠক, আপনি এর প্রায় সবটাই শুনে থাকবেন। কিন্তু যে উত্তরটি লিখিতভাবে বোধ করি কেউ দেননি বলে অনুমান তা হলো, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি শুধু ‘রচিত’ নয়, এটি কবির ওপর ভর করেছিল।”
জানা যায়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখা হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। এবং ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় এই কবিতাটি ছেপে বেরোয়। কবিতাটি বেরোনোর পর ওই কাগজের চাহিদা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে তা দু’বার ছাপতে হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় এই কবিতা আবার ছাপা হয়।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছেপে বের হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল তা জানা যায় শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখায়। এই অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য আলিপুর বোমা মামলায় বারীন ঘোষের সহবন্দী ছিলেন। তিনি লিখছেন, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতে কবিগুরুকে কবিতাটি পড়ে শোনানোর পর কবিগুরি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।
নজরুল গবেষক ও বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত রফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “বাংলা কবিতায় একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লেখা। কেউ কেউ সেই বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি বাইরে যেতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন”। তিনি আরও বলেন, “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।”
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের একেবারে প্রথমে ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যদলের (Royal Indian Army) সদস্য ছিলেন। সেখানে তিনি হাবিলদার পদমর্যাদায় চাকরি করতেন। ফলে, নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নামের আগে সব ক্ষেত্রেই ‘হাবিলদার’ কথাটি তিনি ব্যবহার করতেন। কিন্তু ১৯২২ সালে বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশের পর যখন তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে পরিচিতি পেতে থাকেন তখন তিনি নামের সামনের ‘হাবিলদার’ শব্দটি বাদ দিয়ে দেন। এই কবিতার রচনাবৈশিষ্ট্যই যে তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে পরিচিতি দেয় তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়।