
বিহঙ্গী বিশ্বাস, স্নেহা সেনগুপ্ত, মহুয়া দত্ত
‘বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান। সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখুন’—কোভিড পরিস্থিতির পর থেকে টালিগঞ্জে এ এক নতুন স্লোগান। এই স্লোগান প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী প্রত্যেকেই দিয়ে থাকেন। পুজোর শুভেচ্ছা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে এই স্লোগান দেওয়াটাও যেন এখন বাধ্যতামূলক। শুধু পুজোর শুভেচ্ছা কেন, সব কিছুতেই এই স্লোগান চলছে, চলবে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। যে কোনও উৎসবেই সিনেমা রিলিজ সব ভাষার ক্ষেত্রেই আরও একটা উৎসবের মতোই। সকলে অপেক্ষা করে থাকে উৎসবকে ঘিরে সিনেমা মুক্তি পেলে ভাল ব্যবসার আশায়। অর্থাৎ সরস্বতীকে দিয়ে লক্ষ্মী লাভ। কাল, রবিবার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। বাংলা সিনেমা এই বছরের পুজোতে কতটা লক্ষ্মী লাভ করতে পারল, তার হাল-হকিকত দেখল TV9 বাংলা।
এই বছর তিনটে বড় ছবি মুক্তি পেয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির দাদা-ভাই প্রসেনজিৎ-দেব একসঙ্গে জুটিতে এসেছেন ‘কাছের মানুষ’ ছবি দিয়ে। আর এক ভাই আবির চট্টোপাধ্যায় তাঁর পরের ভাই অর্জুন চক্রবর্তী এবং ইশা সাহাকে নিয়ে প্রায় বছর চারেক পর ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন। দাদা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ই বা কেন পিছিয়ে থাকবেন? তিনিও শুভশ্রীকে নিয়ে খুলেই ফেললেন একটা আস্ত ‘বৌদি ক্যান্টিন’।
প্রথমেই আসা যাক বঙ্গের কোন-কোন সিনেমা হলে বাংলা ছবি চলে, সেই বিষয়ে। সিঙ্গল স্ক্রিন। “৭৫০টি সিনেমাহল (সিঙ্গল স্ক্রিন) ছিল আমাদের সময়, এখন ৪০টি”, এই বক্তব্য অভিনেতা চিরঞ্জিতের। প্রথমেই সামগ্রিকতায় ধাক্কা। মাল্টিপ্লেক্সের অতিরিক্ত টিকিট মূল্য এমনিতেই দর্শককে হলমুখী করাতে অপারগ, আর কোভিডের পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। “কদিন পর ওটিটি-তেই তো চলে আসবে, এত টাকার টিকিট কেটে কী হবে”—এই বক্তব্য আজকাল হামেশাই শোনা যায়। যে কোনও ভাষার সিনেমাকেই যেন এখন এই বক্তব্যের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। তাই এমন কিছু কনটেন্ট দিতে হবে যাতে দর্শক সিনেমা হলমুখী হন বা টিকিটের দাম কম করতে হবে, যেমন জাতীয় সিনেমা দিবসে সব টিকিট শুধু মাত্র ৭৫ টাকায় হওয়ায় প্রেক্ষাগৃহ ছিল পূর্ণ।
তবে এই চিত্রটা তো শুধু মাত্র কলকাতার। শহর আর শহরতলি ছাড়িয়ে মফস্বলের অবস্থা খুব খারাপ। মালদায় ‘রূপকথা’ সিনেমা হলের মালিক উদয় চৌধুরী যেমন ৭৫ টাকায় সিনেমার বিষয়টা জানেনই না। এখন মালদায় তিনটে সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল চলছে। মাল্টিপ্লেক্স নেই। কারণ দর্শক একেবারেই সিনেমা হলমুখী নন। ‘রূপকথা’ ছাড়াও ‘নটরাজ’ আর ‘নবীন’ সিনেমা হল। উদয় চৌধুরীর কথায়, “আমি আমার সিনেমা হলে সবচেয়ে বেশি বাংলা সিনেমা চালাই। এসি হল। অনলাইন বুকিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু দর্শক কোথায়? ব্যবসা না হলে চালাব কী করে? আর দর্শকদেরও আরামে সিনেমা দেখার সুযোগ করে দেব কী করে?” তাই ব্যবসা ঠিক রাখতে তিনি ভরসা রেখেছেন হিন্দি ‘বিক্রম বেধা’ ছবিতেই। তিনি আরও জানান, শুধু এবারই নয়, বেশির ভাগ সময়ই এক সঙ্গে বাংলা আর হিন্দি দু’টো বড় রিলিজ হলে আগে হিন্দি চালিয়ে একসপ্তাহ পর বাংলা ছবির শো রাখা হয়।
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির দেশবন্ধু পাড়ায় একটাই সিঙ্গল স্ক্রিন ‘নিউ সিনেমা’ হলে সকালে ১০.৪৫-এ একটাই শো ‘কাছের মানুষ’ ছবির। আর রয়েছে আইনক্স। সেখানে চলছে ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’। এসভিএফ প্রযোজনা সংস্থার তিনটে সিঙ্গল স্ক্রিন রয়েছে বোলপুর, মগরা, ধনেখালিতে। এসভিএফ সিনেমার তরফে ভাইস প্রেসিডেন্ট সিনেমাজ়-এর রুদ্র প্রসাদ দঁ জানিয়েছেন, পুজোর চারদিন খুব ভাল ব্যবসা করেছে ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’। তারপরই রয়েছে ‘কাছের মানুষ’। তবে ‘বৌদি ক্যান্টিন’-এর তেমন ভাল খবর নেই। ছবি রিলিজ থেকে প্রথম সপ্তাহে ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ ৫৭ হাজার টাকার ব্যবসা করেছে। সংস্থার তরফ থেকে অন্য একটি বিবৃতিতে দাবি, এযাবৎ ৫ কোটি ৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছে এই ছবি। রুদ্রের বক্তব্য অনুযায়ী, পুজোর চারদিন ‘কাছের মানুষ’ও খুব ভাল ব্যবসা করেছে।
যাঁর ছবি এই পুজোয় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ভাল ব্যবসা করছে, সেই ‘সোনাদা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি’র পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় স্বভাবতই খুব খুশি। তিনি বলেছেন, “তিন বছর বাদে মানুষ যে আবার মাস্ক ছাড়া সিনেমা হলে ফিরে এসেছে, এটাই একটা দারুণ ব্যাপার। সিনেমা-থিয়েটার এই দু’টোই কিন্তু একটা কমিউনিটির অনুভূতি দিয়ে থাকে। এতজন একসঙ্গে বসে হাসে-কাঁদে-হইহই করে। সেটা যে ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’-এর হাত ধরে আবার ফিরে এসেছে, এটাই এই ছবির সবচেয়ে বড় পাওনা।”
পরিচালক পথিকৃৎ বসু কী বললেন নিজের ছবি ‘কাছের মানুষ’-এর ব্যবসা নিয়ে? “ছবির ভালই ফিডব্যাক পাচ্ছি। যাঁরা-যাঁরাই এই ছবি দেখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ভাল বলেছেন। এমনকী প্রত্যেকের রিপোর্ট এবং রিভিউ-ও ভাল পেয়েছি। কিছু-কিছু হলে হাউজ়ফুল শো চলেছে। ‘নন্দন’ প্রায় সাতদিনই হাউজ়ফুল হয়েছে। ‘প্রিয়া’য় ৫দিন হাউজ়ফুল ছিল। মাঝে একদিন ‘নবীনা’য় হাউজ়ফুল ছিল। ‘স্টার’ও হাউজ়ফুল ছিল।”
জেলার সিঙ্গল স্ক্রিনের অবস্থা তো খুব খারাপ। কিন্তু কলকাতায় এখন পর্যন্ত যে ক’টি সিঙ্গল স্ক্রিন রয়েছে এবং যারা নিয়মিত বাংলা ছবি চালান হলে, তাঁদের এই বছর বাংলা সিনেমা কতটা ব্যবসা দিল? ‘প্রিয়া সিনেমা’র কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত (দাদুল) বলেছেন, “খুব ভাল পারফর্ম করেছে ‘কাছের মানুষ’। আমি ভীষণ খুশি। আমরা ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ চালাইনি। তবে ‘কাছের মানুষ’-এর ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ শতাংশ পূর্ণ ছিল প্রেক্ষাগৃহ।” ‘নবীনা’ সিনেমা হলের কর্ণধার নবীন চৌখানি জানিয়েছেন যে, এক সপ্তাহে সাড়ে চার লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে ‘কাছের মানুষ’-এর। দিনে একটি করে শো চলেছে ‘কাছের মানুষ’ ছবিটির। ‘বিক্রম বেধা’র তিনটি শো চলেছে, বিক্রি হয়েছে ১১ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
‘মেনকা’ সিনেমা হলের কর্ণধার প্রণব কুমার রায় উচ্ছ্বসিত ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’-এর ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ পারফর্ম্যান্সে , “প্রথম সপ্তাহ পুরো হাউজ়ফুল ছিল। একটি করে শো চলেছিল। সেখানে সাড়ে ৫ লাখের কাছাকাছি বিক্রি হয়েছে। সিঙ্গল স্ক্রিন হাউজ়ফুল হওয়া কিন্তু মুখের কথা নয়।”
‘অজন্তা’র কর্ণধার শতদীপ সাহা বললেন, “আমার হলে ‘কাছের মানুষ’ ও ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’ দু’টোই চলেছে। দু’টোরই ভীষণ ভাল পারফর্ম্যান্সে। দু’টোর ক্ষেত্রেই সিনেমা হলে দর্শক আসন ৯০ শতাংশের বেশি ভর্তি ছিল। দু’টো ছবির ক্ষেত্রেই প্রায় দেড় লক্ষ প্রতি ছবি আয় হয়েছে।”
‘বৌদি ক্যান্টিন’ ছবির পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনি এখন ভোপালে তাঁর পরের হিন্দি সিনেমা ‘নোটারি’-র শুটিংয়ে ব্যস্ত। যোগাযোগ করা হলে রাতে কথা বলছি বলে আর ফোন তোলেননি। সিনেমাপ্রেমীদের মন-পেট কতটা ভরাতে পারল তাঁর টিম, তা স্পষ্ট নয়।