
মেলোড্রামা নেই, অথচ ভাই-বোনের জীবনের টানাপোড়েন এত রক্ত-মাংসের হয়ে উঠে এসেছে ‘স্বার্থপর’ ছবিতে, যে বলা যায় ২০২৫-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘স্বার্থপর’। জেন আলফা বা জেন জি প্রজন্মে নিশ্চয়ই নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়ে বেড়ে উঠছে একটা বাড়িতে। কিন্তু তার আগের বেশ কিছু প্রজন্ম আছে, যাঁরা নারী-পুরুষের সমানাধিকারের পরিবেশে বেড়ে ওঠেনি। সেটা যত কষ্টের, তারচেয়েও হাজার গুণ বেশি কষ্টের হলো, যে বোন বা দিদি, তাঁর ভাইয়ের সমান যত্ন পেল না, সে কোনওদিন মুখ ফুটে কিছু না বলেই, একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। কেন? সাহসের অভাব।
কিন্তু আমরা এমন সমাজ চাই না, যেখানে মেয়েরা সমানাধিকারের কথা বলতে পারে না। মেয়েদের প্রাপ্য ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য গলার আওয়াজ তুলতে পারে না। কারণ একজন নারী পিছিয়ে গেলে, ক্রমশ বহু নারী পিছিয়ে যায়। যা চলে আসছে, তা-ই চলতে দিলে, সামনের ১০০ বছরও মেয়েরা প্রাপ্য যত্ন পাবে না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘স্বার্থপর’ ভাই-বোনের যে গল্পটি বলে, তা হৃদয়ে ধাক্কা দেয়। গল্পটা ধরিয়ে দিই। মধ্যবিত্ত একটা বাড়ি। বোনের বিয়ে হয়ে সে শ্বশুরবাড়িতে আছে। মাঝে-মাঝে ব্যবসা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কেন সে ব্যবসা করতে চাইছে? কারণ অস্তিত্ব হাতড়াচ্ছে। একদিন বরকে না বলে ৫০,০০০ টাকা নেওয়াতে, বর রেগে যায়। বর রেগে যাওয়াতে সে আসলে অনুভব করে, তার নিজের উপার্জনের ৫০,০০০ টাকা হলে, এই অপমানের মধ্যে সে পড়ত না! অপু নামের এই চরিত্রটি করেছেন কোয়েল মল্লিক।
অন্যদিকে গঙ্গাপাড়ে পৈতৃক বাড়িতে থাকে দাদা-বৌদি। দাদার চরিত্রে কৌশিক সেন। তার অর্থ উপার্জন কিছু বেশি হলে ভালো হয়। যে কারণে গঙ্গার ধারে হোমস্টে করার জন্য বাড়িতে বোন যে অংশটায় থাকত, সেটা বিক্রি করে দেবে ঠিক করে। বোন প্রথমে দাদার উপর ভরসা থেকেই, কাগজে সই করে দেয়। কিন্তু পরে সে বুঝতে পারে, তাকে আদালতে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, বাবা-মায়ের বাড়ির উপর তার কোনও অধিকার নেই। এই মুহূর্তটায় সারা জীবন ধরে সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার ছাঁচে পড়ে যাওয়া মেয়েটিও বেঁকে বসে। এরপর লড়াই আদালতে। কী হবে শেষে, তা টিকিট কেটেই দেখতে হবে।
এই ছবির পরতে-পরতে মেয়েদের সম্পর্কে এমন অনেক কিছু বলা আছে, যা আমরা জানি। নিয়মিত দেখি। তবে আলাদা করে উল্লেখ করি না। যেমন পরিবারের মানুষদের কষ্ট হবে ভেবেই মেয়েরা আদালতে মামলা করতে চান না। মেয়েদের কোনও কিছুতে দম বন্ধ লাগলে, তাঁরা একা ঘরে কেঁদে নিয়ে আবার নিত্য কাজে যোগ দেয়, অথচ গলার আওয়াজ তুলে পাওনা ছিনিয়ে নেন না। আসলে মেয়েরা এসব করলে, তাঁদের গায়ে ‘স্বার্থপর’ তকমাও চলে আসে খুব সহজে।
এমন মেয়েদের হারিয়ে দেওয়া সমাজে, কীভাবে জয় ছিনিয়ে আনতে পারে মেয়েরাই, সেই গল্প প্রায় নিখুঁত চিত্রনাট্য সাজিয়ে বলেছেন নতুন পরিচালক অন্নপূর্ণা বসু। অন্নপূর্ণা ছবির দুনিয়ায় হাত পাকাচ্ছেন বহু দিন ধরেই। পরিচালক হিসাবে পথচলার শুরুতে যে ছবিটা তিনি বানিয়েছেন, তাতে বলা যায়, তাঁর পরবর্তী কাজের দিকেও নজর রাখতে হবে। এই ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনায় দায়িত্ব রয়েছেন জিত্ গঙ্গোপাধ্যায়। গানের জন্য ছবিটা তৈরি হয়নি, ছবির জন্য গানগুলো তৈরি হয়েছে। যে গান গল্প এগিয়ে দেয়, যে গান কানেও আরাম দেয়।
এবার আসি অভিনয়ের কথায়। কোয়েল মল্লিক টলিউডের রানি। ব্লকবাস্টার তাঁর ঘরে বহু আছে। কিন্তু ‘হেমলক সোসাইটি’-র পর যে ছবিতে অভিনয়ের জন্য দর্শক কোয়েলের কথা আজীবন মনে রাখবেন, সেটা ‘স্বার্থপর’। ছবিতে কোয়েল-কৌশিক ভাই-বোনের জুটি হিসাবে এতটাই জ্যান্ত, মনে হয় সত্যি তাঁদের জীবনের টানাপোড়েনের মধ্যে হঠাত্ প্রবেশ করেছি। রঞ্জিত মল্লিক এই ছবিতে এক আইনজীবীর চরিত্রে, যাকে কোর্ট চত্বরে যুধিষ্ঠির বলা হয়। ছবির ক্লাইম্যাক্সে তাঁর চরিত্র যখন কিছু কথা বলে, তখন দর্শক হাততালি না দিয়ে থাকতে পারবেন না, একই সঙ্গে চোখের জল মুছবেন। বাংলা ছবিতে কোর্টরুম ড্রামার ক্লাইম্যাক্স অনেক সময়ে জমে না। খুব ঘন-ঘন এমন দৃশ্য দেখা যায়, সেটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে এই ছবির ক্লাইম্যাক্সটি ফিক্সড ডিপোজিটের মতো। অনির্বাণ চক্রবর্তীও আইনজীবীর চরিত্রে। তার চরিত্রটির প্রতি প্রথমে রাগ জন্মায়। ছবির শেষে তার চরিত্রটি ঘিরে উপলব্ধি যেভাবে বদলায়, তাতে বুঝি, অত্যন্ত সংবেদনশীল এই ছবি।
স্বার্থপর শব্দটা বড় আঘাত দেয় নরম মনকে। কিন্তু এই সমাজকে স্বার্থপর তকমা থেকে বের করতে হলে, মেয়েদের যে একটু ‘স্বার্থপর’ হতেই হবে, সেই বার্তা বেশ দক্ষতার সঙ্গে দিল কালীপুজোয় মুক্তি পাওয়া নতুন ছবিটি। যদি সারা বছরে চার-পাঁচটা ছবিও দেখবেন বলে ঠিক করেন, তার মধ্যে ‘স্বার্থপর’ রাখুন।