জীবনে যদি একজন ‘ভবানী পাঠক’কে পেতাম…কেমন হলো ‘দেবী চৌধুরানী’?

প্রফুল্ল নামের এক অভাগা মেয়ের গল্প। জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়, তবে শ্বশুর তাকে তাড়িয়ে ছাড়ে। সে মেয়ে সাহসী। তবে মেয়েকে হারেমে ভরার তোড়জোড়ের রাতে, সে অসহায় হয়ে যায়। তখন ভবানী পাঠকের দলবল তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ভবানীর আস্তানায়। 'দেবী চৌধুরানী' উপন্যাসের গল্প আমাদের জানা। প্রফুল্ল চরিত্রটিকে কেমন ভাবে গড়েছিলেন কিংবদন্তি সাহিত্য়িক, সে কথাও অজানা নয়।

জীবনে যদি একজন ভবানী পাঠককে পেতাম...কেমন হলো দেবী চৌধুরানী?

|

Sep 28, 2025 | 6:10 PM

প্রফুল্ল নামের এক অভাগা মেয়ের গল্প। জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়, তবে শ্বশুর তাকে তাড়িয়ে ছাড়ে। সে মেয়ে সাহসী। তবে মেয়েকে হারেমে ভরার তোড়জোড়ের রাতে, সে অসহায় হয়ে যায়। তখন ভবানী পাঠকের দলবল তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ভবানীর আস্তানায়। ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসের গল্প আমাদের জানা। প্রফুল্ল চরিত্রটিকে কেমন ভাবে গড়েছিলেন কিংবদন্তি সাহিত্য়িক, সে কথাও অজানা নয়। প্রফুল্ল চরিত্রে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় যে নজর কাড়বেন, সেই প্রত্যাশা ছিল। শ্রাবন্তীর পরিণত অভিনয় আর দারুণ স্ক্রিন প্রেজেন্সে চোখ রাখার জন্য ছবিটা দেখতে পারেন।

এই গল্প বাঙালির পড়া। তবু রিভিউতে একটা-দু’টো লাইন লিখে দেওয়ার অভ্যাস থেকে বিরত হলাম না। প্রফুল্ল ঘরছাড়া হওয়ার পর হারেম যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। তার জায়গা হয় ভবানী পাঠকের দলে। ভবানী পাঠক কীভাবে প্রফুল্লকে দেবী-রূপ দেবে, আর কীভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে ভবানী-দেবীর যুগলবন্দি, সেটাই দেখার। ভবানী পাঠকের দলে নিশি (বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়), রঙ্গরাজের (অর্জুন চক্রবর্তী) মতো চরিত্ররা রয়েছে। প্রফুল্লর বরের চরিত্রে কিঞ্জল নন্দ। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর চরিত্র করেছেন দর্শনা বণিক। দেখতে ভারি মিষ্টি লেগেছে তাঁকে। চরিত্রটির টানাপোড়েন ফুটিয়ে তোলার কাজে মানানসই অভিনেত্রী। শ্বশুরমশাইয়ের চরিত্রে পাওয়া গেল সব্যসাচী চক্রবর্তীকে। নিশির চরিত্রে বিবৃতির উপস্থিতি এটাই জানান দেয়, তাঁর মধ্যে আগামীতে এগিয়ে যাওয়ার বীজ আছে। দেবীর চরিত্রটি বাদে এই ছবিতে যাঁর দিক থেকে চোখ ফেরানো যায়নি, তিনি অবশ্যই প্রসেনজিত্‍ চট্টোপাধ্যায়।

প্রসেনজিত্‍ চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টি-শক্তি বরাবরই চুম্বক। এই ছবিতে তাঁর প্রয়োগ যেন ব্রহ্মাস্ত্র। ভবানী পাঠক চরিত্রে তাঁর রূপ-নির্মাণ নজরকাড়া। যতটুকু সময় তিনি বড়পর্দায় উপস্থিত থেকেছেন, শত্রুপক্ষ নিধনে মেতেছেন, শিরদাঁড়া সোজা করে ছবি দেখেছি। ভবানীর মুখে প্রফুল্লর জন্য ‘মা’ ডাক, মনে বড় আরাম দেয়। মনে হয়, এই জীবন-যুদ্ধে আমরা সকলেই একজন ভবানী-পাঠককে খুঁজছি, যে আমাদের মধ্যের ঘুমন্ত-শক্তিকে জ্রাগত করতে পারে। এই বিশ্ব, এই দেশ, এই রাজ্য নারীদের উপর অত্যাচারের কষ্টে আজও বড় কাঁদে। কালও কাঁদবে, তা টের পাই। সেখানে নারীর তরবারি হাতে তুলে নেওয়ার গল্প, কোথাও হৃদয়ে ধাক্কা দেয়।

বাংলায় বড় ক্যানভাসের ছবি তৈরি করার চেষ্টা করছেন যাঁরা, তাঁদের কিছুক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হচ্ছে। একটা বাংলা ছবিতে কত বিনিয়োগ করলে তা ফেরত আসবে, এই হিসাব কষে যে বাজেট নির্ধারণ করা যায়, তাতে বড় ক্যানভাসের ছবি-কেন্দ্রিক কিছু শখ পূরণ হয় না। তাই কলম-চিত্রনাট্য আর বড়পর্দায় তার প্রতিফলনে কিছুটা ফারাক থাকে। দেবী চৌধুরানীতে সেই ছন্দপতন চোখে পড়ে কিছু জায়গায়। তখনই ছবি গতি হারিয়েছে। তবে দুই তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর টান দর্শক এড়াতে পারবেন না। ছবির জোরের জায়গা সঙ্গীত এবং আবহসঙ্গীত। বিক্রম ঘোষ এই ছবির আত্মার সঙ্গে দর্শকের আত্মা জোড়ার সূত্রটি ভারি দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। শিল্পীদের কণ্ঠের শক্তি এই ছবির শক্তির সঙ্গে মিশে যায়। ছবি জুড়ে ভিএফএক্সের খেলা। তাতে কিছু জায়গায় ভালো নম্বর উঠলেও, কিছু ক্ষেত্রে থমকে যাওয়ার ইঙ্গিত আছে।

তবে দুর্গাপুজোর মরসুমে এই ছবির গুরুত্ব আলাদা। দেবী আসেন অশুভ শক্তির বিনাশে, তা আমাদের মজ্জাগত। এই ছবিতে নারী চরিত্ররা যেভাবে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, তা আজকের নারীদের অশুভ শক্তির বিনাশে ইন্ধন জোগাতে পারে। মাথায় রাখা দরকার, অস্ত্রও রূপক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই প্রধান। দেবী চৌধুরানী চরিত্রটি এর আগে বড়পর্দায় এসেছে। সেই ছবিতে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে দর্শক দেখেছেন। সেই সময়ের নির্মাণ আর আজকের নির্মাণে ফারাক অনেক। কিন্তু এই ছবি দেখতে বসে মনে হয়, অতীতের ছবির প্রভাব এখনও টাটকা। বাংলার নায়িকাদের বড়পর্দায় তাক লাগানো চরিত্রে উপস্থিতির এ এক উত্তরাধিকার। ছবিতে বেশ কিছু অ্যাকশন দৃশ্য আছে। সেগুলো যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, সেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে শক্তির প্রদর্শন করেছেন, তা দেখতে দারুণ লাগে। ভবানী যেখানে দেবীর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তাকে অস্ত্র-চালনা শেখায়, সেটাও মনে রাখার মতো দৃশ্য।

এ গল্পে বহু পরিচিত ছন্দেই এক পুরুষের দুই স্ত্রী। তাঁরা দু’ জনেই ভালোবাসার কাঙাল। নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার অপরাধেই তাদের চোখের কোণে জল আসে। পরিস্থিতি এই পুরুষ চরিত্রটিকেও অসহায় করে দেয়। এক যুগ থেকে অন্য যুগে পা রাখে মানব-সভ্যতা। কিন্তু ভালোবাসার কারণে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামে না। এই কষ্ট আপনার-আমারও। তবু থামতে নেই। ভবানী পাঠক বলে, এ পৃথিবীতে কিছু নিতে আসিনি আমরা। কিছু দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। রক্তক্ষরণ বা রক্তপাত সব হবে, তবু নিজের কান্না ভুলে সেই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে, যাঁরা বড় কাঁদছে।