Review: ‘এখন অনেক ভোর, তুমি বেঁচে আছ আমার ভালোবাসায়…’, কেমন হল ‘কিলবিল সোসাইটি’
এ ছবি জটিল নয়। একটু দুষ্টুমি আছে। অসম্ভব মিষ্টি প্রেম আছে। প্রাক্তন আর বর্তমানের প্রেমে একসঙ্গে ভেসে যাওয়ার নির্যাস আছে এই ছবিতে। সৃজিতের সেরা পাঁচ ছবির মধ্যে এটাকে না রাখলেও, এই ছবির কাছে দর্শক হিসাবে ফিরে আসতে হবে আজ, কাল বা পরশু, সেটা অনুভব করি।

‘কিলবিল সোসাইটি’ একটা প্রেম। যে প্রেম খুঁজে আর না পেয়ে আমি বা আপনি অনেক চোখের জল ফেলেছি। কখনও ভেবেছি, পরদিনের সূর্য ওঠা দেখার আগেই কেটে পড়ব! ওই প্রেম খুঁজতে অনেক কাজ বিসর্জন হয়েছে। একটা বা দু’টো-তিনটে বিয়ে ‘নেমে’ গিয়েছে। কিন্তু লাভের ‘লাভ’ সেটাকে বলা যায় না! দু’ দিন ছিল প্রেম। তিন দিনে পীড়া। প্রথম দু’ দিন আত্মার যোগ। তারপর প্রেতাত্মার ডাক। ওই যে পিঠ চাপড়ানোর আত্মাটা, যে দাঁড়িয়ে বলবে, আনন্দ কর বা দুঃখটা এনজয় কর, সে তো টাটা বাই বাই। বাকিটা পড়ে থাকা শরীর। অভ্যাস। মায়া। হতাশা। দিশেহারা ভাব।
‘কিলবিল সোসাইটি’ সেই খোকাবাবু বা কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন! যদি যে কোনও ফর্মে বা শেপে অসুবিধা না থাকে, তা হলে ‘কিলবিল সোসাইটি’ সেই ঝিন্টি, যে বৃষ্টি হতে পারে বা বৃষ্টি নামাতে পারে। এই গল্পের কেন্দ্রে ইনফ্লুয়েন্সার থেকে নায়িকা হয়ে ওঠা পূর্ণা আইচ। বাড়ি তাকে বোঝেনা। দিদি বোঝে, তবে উত্তরবঙ্গের মেয়েকে মায়ের আঁচল ছেড়ে বেরোতে হয়, কোটি-কোটি লাইক কুড়োতে। বয়ফ্রেন্ড ‘অ্যানিম্যাল’ না হলেও, তার সন্দেহ বাতিক প্রবল। পূর্ণা একটা অ্যাওয়ার্ডে বাকি নায়িকাদের পিছনে ফেলে আরও একটু নজর কাড়তেই বয়ফ্রেন্ড নিজের নিরাপত্তাহীনতা ঢাকতে, পূর্ণাকে দীন-হীন প্রমাণের চেষ্টায় নেংরামো করে। নিজেদের যৌনতার একটা দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেয় সে অনুমতি ছাড়া। মুহূর্তে পূর্ণার পায়ের তলার মাটি নড়ে যায়। ক্রমশ অবসাদ এতটাই গ্রাস করে পূর্ণাকে যে সে নিজের খুন করার জন্য ভাড়াটে খুনি খোঁজে। পূর্ণার চরিত্রে কৌশানী মুখোপাধ্যায়, তার টক্সিক বয়ফ্রেন্ডের চরিত্রে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। ভাড়াটে খুনি হয়ে দরজায় বেল দেয় মৃত্যুঞ্জয় কর। যে মৃত্যু এনজয় করাতে পারদর্শী। এরপর কী হয়? ক্রমশ প্রকাশ্য! ডুব ডুব ডুব প্রেম সাগরে বলাটাই যথেষ্ট। ছবি শেষ হওয়ার পর মনে হয়, এখন অনেক ভোর, তুমি বেঁচে আছ আমার ভালোবাসায়। হ্যাঁ, ছবিটা যেমন ‘হেমলক সোসাইটি’-র উত্তরাধিকার বহন করছে, তেমনই উলটপুরাণে সারপ্রাইজ দেয়।
‘কিলবিল সোসাইটি’ একশো শতাংশ গাওয়া প্রেমের ছবি। প্রেম করার জন্য বাঁচার ছবি। এক জীবন বাঁচা আর প্রেম করা যে সমার্থক, সেই পুরাতন পাঠ নতুন করে পড়ার ছবি। প্রেমে একা, বোকা বা ন্যাকা না হয়ে, প্রেমের বাহানায় পৃথিবীকে উন্নত করার ছবি। এবং ‘কিলবিল সোসাইটি’ সৃজিত মুখার্জির ছবি। যেখানে আনন্দ করের সংলাপে বহু টুকরো সৃজিত। যেখানে কৌশানী মুখোপাধ্যায়-অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয়ের পিছনে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে চক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজিত। যেখানে বিশ্বনাথ বসুর হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে বলে, কলমে শান দেওয়া সৃজিত প্রকট। পরমব্রত ছবিতে অসাধারণ। অভিনেতা কেমন পরিচালকদের জীবনের আনন্দ কর হয়ে উঠছেন!
অনিন্দ্যর কাজ চমকে দেবে। বিশ্বনাথের যেন এই উপহার পাওনা ছিল সৃজিতের কাছে। আর কৌশানী জীবনের সেরা অভিনয়টি করার সুযোগ পেয়েছেন এই ছবিতে। এখনও পর্যন্ত যা করেছেন, সেই নিরিখে। বরং সন্দীপ্তা সেনের অত কিছু করার নেই। তবুও তিনি বেশ ভালো। ছবিতে গান একটা সময়ে স্পেস না দেওয়ার আগেই ঢুকে আসে। প্রেমে যেরকম হয় আরকী! ‘কিলবিল সোসাইটি’ ছবির গানগুলো সব স্ফুলিঙ্গ, যা বড়পর্দায় একত্রে দাবানল। তবে ছবিটার সেরা সম্পদ হলো সংলাপ। আধুনিক, ঝাঁঝালো, সেন্স অফ হিউমারে চোবানো, চুম্বকের মতো।
ছবির খামতি কোথায়? টানটান প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে গতি একটু কমে। তারপর আবার জার্নি সং জমে। পূর্ণার বাড়ির একটা দৃশ্যে পাড়ার লোকের দাঁড়িয়ে থাকাটা একটু সাজানো। তাদের চলে যেতে বলার পরও দাঁড়িয়ে আছে, এরকম হয় না। দিদি-বোনের দৃশ্যটিও বাড়িতে হতে পারত। মানসিক ট্রমায় আবার নাইট ক্লাবে পাঁচশো ফোনের ক্যামেরার সামনে তখনই সে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিল, বোঝা গেল না। তবে এগুলো ছবির গতিকে তেমন আঘাত করেনি। দারুণ কিছু ক্যামিও আছে ছবিতে। টাইটেল মন্তাজটি বাংলা ছবির অন্যতম সেরা ভাবনা। অঙ্কুশ আর কৌশানীর নাচটি নজরকাড়া।
এ ছবি জটিল নয়। একটু দুষ্টুমি আছে। অসম্ভব মিষ্টি প্রেম আছে। প্রাক্তন আর বর্তমানের প্রেমে একসঙ্গে ভেসে যাওয়ার নির্যাস আছে এই ছবিতে। সৃজিতের সেরা পাঁচ ছবির মধ্যে এটাকে না রাখলেও, এই ছবির কাছে দর্শক হিসাবে ফিরে আসতে হবে আজ, কাল বা পরশু, সেটা অনুভব করি। জীবনে অনেক সময়ে জোর করে গিলতে হয়, একটা প্রেমের চেয়ে জীবন অনেক বড়। ‘কিলবিল সোসাইটি’ মগজে ঢুকিয়ে দেয়, একটা প্রেম জীবনকে অনেক বড় করতে পারে।
