জয়িতা চন্দ্র
পরিবারের চাপে ছাড়তে হয়েছিল অভিনয়। ডাবিং, রেডিও নিয়ে কাটতে থাকে সময়। এরপর কীভাবে ভিলেন হয়ে অনামিকা সাহা ফিরলেন পর্দায়, কীভাবে শুরু হল কেরিয়ারে দ্বিতীয় ইনিংস? টিভি ৯ বাংলাকে শোনালেন সেই কাহিনি।
ধারাবাহিকে তো ভিলেনের চরিত্র অনেক থাকে, কখনও আপনার ডাক আসেনি?
আমি তো ধারাবাহিক করতাম না, আর আমায় কেউ ডাকেওনি। যাঁরা ধারাবাহিকে অভিনয় করছেন, তাঁরা বোধহয় আমার ওই ছবিগুলো দেখেননি। এখনকার দিনে অভিনয়ের মাস্টার কোথায়? আমাদের সময় মাস্টার ছিল। এখন যাঁরা ধারাবাহিকের পরিচালনা করেন, তাঁদের মধ্যে সেই নিষ্ঠাটার অভাব। কোথায় থামতে হবে, কোথায় বলতে হবে—অভিনয় সম্পর্কে সেই জ্ঞানটুকুর অভাব। ক্রিপ্ট ধরিয়ে দেবে আর বলবে, মুখস্থ করোনি? এই জন্যই আমি ‘আলোছায়া’ করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর করব না। এই অভিনয় আমি আর করব না। ‘ভানুমতীর খেল’টা বেশ ভাল লেগেছিল। সেটা করার পর আর করিনি।
আপনার পরবর্তীতে কোনও মহিলা খলনায়িকা কি সেই জায়গাটা করতে পেয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
না, না, না, না (টানা চারবার ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করেছেন অনামিকা)। দুঃখিত। তাঁরা ওই মাত্রায় অভিনয় করতে পারবেন না। পরিচালকেরা করাতেও পারবেন না। একটু চোখ পাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে কথা বললেই সেটা নেগেটিভ চরিত্র হয় না। আমার চরিত্র মানুষের মনে দাগ কেটে গিয়েছে। এখনও গ্রামে গেলে সকলেই একবাক্যে আমার সংলাপ বলে ওঠে। এখন কোন ছবির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে? সবাই তো নায়ক-নায়িকার কথা মনে রাখে, মা-শাশুড়ির কথা কতজন মনে রাখে? ২০ হাজার, ২৫ হাজার মানুষ বলে চলে আমার সংলাপ। ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ ছবি থেকে ‘কত টাকা নেবে বলো, ৫ হাজার, ১০ হাজার?’ ব্যস, চিৎকার করে সামনে থাকা দর্শকেরা ছবির নাম বলে ওঠে। ১৯৯৪-এ মুক্তি পেয়েছিল ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’… ভাবতে পারবেন না এখনও কতটা ভালবাসা পায়। মনে-মনে ভাবি এটাই আমার পরম পাওয়া। স্টার হয়তো হইনি। কিন্তু মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি।
কীভাবে খলনায়িকা হয়ে টলিউডে প্রত্যাবর্তন?
তাহলে প্রথমে ফিরে যেতে হয়। আমার তখন বয়স ১৬ বছর। তরুণ মজুমদারের ছবিতে কাজ করি। স্কটিশ চার্চ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিলাম। ছবি হয়ে গেল, বাড়িতে মারধর শুরু হল। ছবি করতে দেবে না। তখন ছবি করা মানে আত্মীয়-স্বজনরা মাকে ডেকে বলত, ‘তোমরা কি খেতে পাও না যে, মেয়েকে বায়োস্কোপে দিয়েছ?’ সে সব শুনে তো আমি অবাক, তবে কথায় বলে না কপালে থাকলে তা হবেই। আমি পারলাম না।
শ্বশুরবাড়ি থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছিল?
আমার শ্বশুরমশাই বললেন, ‘ছবি করো না। তোমার গলাটা সুন্দর, তুমি রেডিয়োয় কাজ করো।’ এরপর আমি ৫০০০-র বেশি নাটকে কাজ করেছিলাম। বম্বের যত ছবি হতো, আমি ডাব করতাম। প্রত্যেকটা হিট ছবি। ‘অমর সঙ্গী’র বিজয়তা আমার করা, জুহি চাওলা আমার করা… স-অ-অ-অ-ব আমার করা। এরপর ১৯৯০-এ একটা ছবি ডাব করে বেরোচ্ছি, একটি লম্বা ছেলে আমায় জানাল, ‘দিদি, বাংলাদেশ থেকে একটি ছবির জন্য আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।’ আমি বলি, আমার বাড়িতে এসে আপনারা আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলুন। তাঁরা সেটাই করেন। এভাবেই আমি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। শুরু হল আমার দ্বিতীয় ইনিংস।
এই সময় বিশেষ কারও কথা মনে পড়ে যিনি টলিউডে আপনাকে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিলেন?
ওরে বাবা, হ্যাঁ তো। অবশ্যই। তিনি হলেন চিরঞ্জিৎ। ও আমায় বুদ্ধি দেয়, ‘তুই একটু মোটাসোটা হয়ে যা। এরপর মাসিমা, ঠাকুমা, দিদিমার চরিত্রে অভিনয় কর। তুই তো অভিনয়টা ভালবাসিস, এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করলে মনে হয় না তোর বাড়িতে কোনও সমস্যা হবে।’ কারণ রোম্যান্টিক দৃশ্য আমার পরিবারের বসে দেখতে আপত্তি ছিল। এরপর শুরু হল আমার নতুন লড়াই। আমি শুরু করলাম মোটা হওয়া। পান্তাভাত, ফ্যানে ভাত… আমার তো এমন চেহারা ছিল না। আগে আমায় দেখলে এখন কেউ চিনতেই পারবে না। এরপর তো একে-একে বিভিন্ন চরিত্র ইতিহাস তৈরি করে দিল।