চর্চিত পরিচালক তিনি। ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর প্রেমের ভাঙা-গড়ার গল্প বহুবার রসদ জুগিয়েছে পেজ-থ্রি’র প্রথম পাতায়। তাঁর চোখে প্রেম কেমন? প্রেম কি শুধুই একমুখী? ভালবাসার দিন বরাদ্দ শুধু প্রেমিক/প্রেমিকার জন্যই? যদি সেই প্রেম পুরনো হয়, যদি তাতে মিশে থাকে নস্টালজিয়া, স্কুলজীবন, বারান্দার রোদ্দুর আর মায়ের হাতের ভাপা ইলিশ…টিভিনাইন বাংলার সঙ্গে কথা বললেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। প্রেমের দিনে শোনালেন আজীবন সাক্ষী থাকা তিন পুরনো প্রেমের সহজ আখ্যান…
বাইশগজ আর ভালবাসা
ক্রিকেটের প্রেমে পড়েছি সেই ছোট থেকেই। ক্রিকেট দেখার চল ছিল বাড়িতে, শুধু দেখাই বা কেন ঘড়ির কাঁটা বিকেল ছুঁলেই ব্যাটবল উইকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। যতক্ষণ না অন্ধকার হচ্ছে সেই খেলা চলতই। কখনও মাঠে আবার কখনও বা রাস্তায়। মাঠ বলতে কখনও নর্দান পার্ক আবার কখনও বা বিবেকানন্দ পার্ক বা দেশপ্রিয় পার্ক। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ম্যাচ খেলা সেই উন্মাদনা আজও মনে পড়ে। জলের মধ্যে চুবিয়ে রাখছি বল যাতে বলের গতি বাড়ে, চলছে প্র্যাকটিস। সে সব এক এক ঐতিহাসিক ম্যাচ। আস্তে আস্তে বড় হলাম। প্যান্টে বল মোছার ওই বেয়াড়া লাল দাগটা এগিয়ে দিল আরও সিরিয়াস ক্রিকেটের দিকে। কলেজ-ইউনিভার্সিটি হয়েও খেলেছি বহুবার। এখন আর ক্রিকেট খেলা হয় না। প্রেমটা রয়ে গিয়েছে আজও তবে পাল্টেছে তার অবয়ব। ক্রিকেট নিয়ে পড়াশোনা চলে আজও। তৈরি করছি ক্রিকেট নিয়ে ছবি। প্রেমের পরিপূর্ণতা কি একেই বলে? মনে আছে ব্যাঙ্গালোরে যেখানে আমার অফিস ছিল তার খুব কাছেই ছিল ক্রিক ইনফোর অফিস। প্রতিদিন অফিসে যখন যেতাম মনে হত একদিন চাকরিটা ছেড়ে একটা সিনেমা বানাব, সিনেমাটা কেউ দেখবে না, চলবে না আর আমি ক্রিক ইনফো জয়েন করব ক্রিকেট অ্যানালিস্ট হয়ে। সিনেমাটা হিট হল, ব্যস আমারও আর ক্রিকেট অ্যানালিস্ট হওয়া হল না। আসলে ক্রিকেট একটা দর্শন। মাঠে প্রতিপক্ষকে এক ইঞ্চি জমি ছেড় না, কিন্তু মাঠ থেকে বের হওয়ার সময় যেন প্রতিপক্ষের কাঁধে হাত থাকে। পরিচালক সৃজিত এই দর্শনবোধে অনুপ্রাণিত কিনা প্রশ্ন করলে উত্তর হবে হ্যাঁ। আসলে প্রথম প্রেম তো। যা শেখায়, মনে থেকে যায়।
গান ভালবেসে গান
যে কটি শিল্পকলা রয়েছে তার মধ্যে সঙ্গীতই এমন একটি কলা যা আমার হৃদয়কে সরাসরি ছুঁয়ে যায়। চোরাগলি হয়ে দিকভ্রষ্ট হয় না। আর এই সঙ্গীতময় পরিবেশেই আমার বড় হয়ে ওঠা। তাই সঙ্গীত আমার দ্বিতীয় প্রেম। বাবা সুধীন দাশগুপ্তর ছাত্র ছিলেন, পিসি আরতি মুখোপাধ্যায়। সেই পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। কানে সরগম, মুখে গান, এভাবেই চলত সময়। বাড়িতে হারমোনিয়াম, তবলা, মা সেতার বাজান, তাই সঙ্গীতের প্রতি প্রেমও সহজাত। মনে আছে, গীতা দত্তের গান শুনিয়ে মা ঘুম পাড়াত। বাবার বিশাল রেকর্ডের কালেকশন ছিল। সেখানে বড়ে গুলাম আলি থেকে জোন বায়েজ, জেশুদাস… বাবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বড় ভক্ত। তাই সঙ্গীতের প্রতি প্রেমটাও অনেক পুরনো। আমি শুধু হারমোনিকা বাজাই। যে সব মিউজিশিয়ান নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন তাঁদের খুব ঈর্ষা হয়। পরবর্তীতে ছবি তৈরির ক্ষেত্রেও বারেবারেই ফিরে এসেছে আমার এই সবচেয়ে পুরনো প্রেম। আমার ছবির কিছু গানের অ্যারেঞ্জমেন্ট আমার। আমার ছবির গানের ক্ষেত্রে আমি খুব ইন্টারফেয়ার করি। অনেক সময়তেই বলেছি এই সুরের জায়গায় এটা হলে ভাল হত, বা অন্যটা। কী করব! প্রথম প্রেম বলে কথা।
মন দিয়েছি খাবারে
এইটা বড় আদরের প্রেম। আর খাদ্য প্রেম দায়িত্ব নিয়ে যিনি লালন করেছেন আমার মধ্যে তিনি আমার বাবা। বাইরে খাওয়ার একটা রীতি ছিল আমাদের। চিনে খাবারের প্রতি আমার দুর্বলতা আমার সেখান থেকেই এসেছে। ছোটবেলায় পিপিং বা আমাদের পাড়ায় অর্থাৎ ইন্দ্র রায় রোডে স্টেপআপ বলে এক রেস্তরাঁ ছিল সেখান থেকে খাওয়া ছিল আলাদাই উন্মাদন। মামা অ্যাস্টার থেকে কাবাব আনতেন, আর বাড়ি থেকে দু’পা এগিয়েই শ্রীহরি। শ্রীহরির মিষ্টি সকালবেলা টিফিনে যেত। আর হ্যাঁ, উজ্জ্বলার চানাচুর– তাঁর কথাই বা ভুলি কী করে? যত দিন গেছে এই প্রেমের জৌলুশ বেড়েছে আরও। তালিকায় যোগ হয়েছে নানা ধরনের মাংস। কুমির হোক বা ক্যাঙ্গারু, জেব্রা, উটপাখি — বাদ দিইনি কিছুই। কাকাবাবু শুটিং করতে গিয়ে আফ্রিকায় গিয়েছিলাম। সেখানেও কুমিরের মাংস খেয়েছি। ফ্লোরিডায় খেয়েছি অ্যালিগেটর। সাপও কিন্তু বাদ দিইনি। র্যাটল স্নেক মন্দ লাগেনি আমার। এরকম রকমারি খাবার চেখে দেখার মানুষ বড় কম। তাতে কী? পেট আর প্রেমের আদ্যক্ষর এক। তাই সমমনস্ক কাউকে না পেলে আমার এই খাদ্য প্রেমের একা অধিপতি আমি। সেই প্রেমের নেই কোনও বাঁটোয়ারা।
(অনুলিখন- বিহঙ্গী বিশ্বাস)