মানুষ শেষজীবনে খুঁটি খোঁজে। সেই খুঁটি খুঁজে পেয়েছিলেন অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদার। ৫০ পেরতেই হাতের কাছে পেলেন বয়সে কিছুটা ছোট তাঁর দুই পাতানো বোন–ঋতু আর রেশমিকে। এই ঋতু অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং রেশমি মিত্র এক বাঙালি পরিচালক। মৃণাল সেনের মৃত্যুর দিন কালো চশমার ফাঁক থেকে গড়িয়ে আসা জল টিশু পেপার দিয়ে মুছতে-মুছতে শ্রীলা TV9 বাংলার প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “আমি মৃণালদার ৬টা ছবিতে অভিনয় করেছি।” এই ‘৬টা’ বলার সময় তাঁর কণ্ঠে মিশেছিল এক অদ্ভুত ‘অহং’। নিজের প্রতি নয়, মৃণাল সেনের প্রতি। মৃণাল সেনের আবিষ্কার ছিলেন শ্রীলা। ‘পরশুরাম’ ছবির হাত ধরে তাঁর অভিনয় জগতে পা রাখা। কেবল মৃণাল সেন নন, শ্যাম বেনেগালের মতো পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছেন শ্রীলা। শাবানা আজ়মি, নাসিরউদ্দিন শাহের সমসায়মিক এই তারকা বন্ধুত্ব এবং পরিবার খুঁজে পেয়েছিলেন রেশমি ও ঋতুপর্ণার মধ্যে। যে কারণে জীবনে মারণ থাবা বসানো ক্যানসারের কথাটা এই দুই বান্ধবী ছাড়া আর কাউকেই বলতে চাননি শ্রীলা। হ্যাঁ, স্বামী-পুত্র জানতেন। এছাড়া কেউ নন।
শ্রীলা মজুমদারের মৃত্যুর খবর আসতেই তাঁর বান্ধবী রেশমি মিত্রর সঙ্গেই TV9 বাংলার প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন প্রথমে। ফোনের ওপার থেকে রেশমির কান্না জড়ানো কণ্ঠ, “শুনেছেন তো খবরটা। তিনি নেই। আমাদের শ্রীলাদি আর নেই। আমি আর ঋতু ছাড়া কেউ জানত না তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি কাউকে বলতে চাইতেন না। আমরাও তাই কাউকে জানাইনি। ক্যানসারটা হয়েছিল জরায়ুতে। এখন তো আমাদের দিদিহারা হতে হল…।”
অদম্য মনের জোর ছিল শ্রীলা মজুমদারের। মারণরোগের সঙ্গে লড়াই করার সময়ও তাঁর মুখে হাসি লেগে থাকত। নিয়মিত দিল্লিতে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। অনেকটা সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শেষ কয়েকদিন হাসপাতাল-বাড়ি করতে হচ্ছিল। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা শরীরে। এই অসুস্থতার মধ্যেও তাঁর মন ভাল করতে ঋতুপর্ণাই শ্রীলাকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকার এনএবিসিতে গিয়েছিলেন ২০২৩ সালে। সেই শ্রীলাদির শেষসময় তাঁর হাত ছেড়ে দেননি ঋতু। ছুট্টে গিয়েছেন তাঁর টালিগঞ্জের বাড়িতে। যে বাড়িতে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে (প্রতিবেদন লেখার সময় দাহ হয়নি শ্রীলার পার্থিব দেহ) শ্রীলার নিথর দেহ। চোখের জল ফেলেছেন দিদিসম মানুষটাকে প্রাণহীন পড়ে থাকতে দেখে।
তাঁর নিজের দিদি নেই। তাই শ্রীলাকেই নিজের দিদির আসনে বসিয়েছিলেন ঋতুপর্ণা। তাঁর চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না মন থেকে। কাঁদতে-কাঁদতে বলেছেন, “আমার এই দিদি সারাক্ষণই আমার মধ্যে শক্তি জুগিয়েছেন। তিনি চিরটাকালই আমাকে বলেছেন, ঋতু তুমি কখনও থামবে না। কখনও ভাঙবে না। সব সময় এগিয়ে যাবে। এই কথাগুলো চিরকাল আমার কানে বাজবে। যতদিন আমি বেঁচে থাকব…। এত স্নেহ, এত ভালবাসা… কোনওদিনও বুঝিইনি আমার নিজের দিদি নেই।”
ক্যানসারের কাছে হার মানতে অনীহা ছিল শ্রীলার। বারবারই তাঁর প্রিয় রেশমি-ঋতুকে বলতেন, তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। কাজে ফিরতে চাইতেন। ভয়েস ওভার দিতে চাইতেন। অভিনয় করতে চাইতেন। তবে মনে অভিমানও ছিল তাঁর। ঋতুপর্ণাই জানিয়েছেন সেই কথা। বলেছেন, “ইন্ডাস্ট্রির অনেকের উপর অনেক অভিমান ছিল আমার শ্রীলাদির…”