পায়েল মজুমদার: অসহ্য যন্ত্রণায় মাটিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছেন পাঁচ শিক্ষিকা। পুলিশ ‘হেলদোলহীন’। পাশে বিকাশ ভবন। হালের ঘটনা, স্মৃতিও টাটকা। তুঙ্গে বিতর্ক। কেন বিষ খাওয়ার আগেই শিক্ষিকাদের আটকাল না পুলিশ, মূল প্রশ্ন এটা নিয়ে। কিন্তু তার পরের অংশটা? বিতর্ক না হোক, নেড়েচেড়েও দেখব না?
বিকাশ ভবনের সামনে ওই ঘটনায় পাঁচ শিক্ষিকার বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ নম্বর ধারাটিও দেওয়া হয়েছে তাতে। এ দেশে আত্মহত্যার চেষ্টাকে অপরাধ প্রমাণ করার আইনি ভিত্তি এই ধারা। তবে ২০১৭-র মেন্টাল হেলথকেয়ার অ্যাক্ট লাগু হওয়ার পর ৩০৯ নম্বর ধারার ধার অনেকটা কমে যায়। ATTEMPT TO SUICIDE-কে অপরাধের তকমামুক্ত করতে আইনি পথ খুলে দেয় মেন্টাল হেলথকেয়ার অ্যাক্ট, ২০১৭। তা হলে কীসের ভিত্তিতে পাঁচ শিক্ষিকার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার চেষ্টার আইনি ‘অভিযোগ’ আনল পুলিশ? জটিল প্রশ্ন। গুরুতরও বটে। কারণ তথ্য বলছে, আগের তুলনায় কমলেও এমন ঘটনা দেশের নানা প্রান্তে এখনও ঘটে।
অগস্ট, ২০২১: পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে প্রতিবাদ ‘পাওয়ারকম’ সংস্থার কর্মীদের। দাবি না মানলে ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝাঁপ দেওয়ার হুমকি। ৩০৯ ধারা ৯০০ জনের বিরুদ্ধে।
মে, ২০২১: গ্রেফতারি এড়াতে নিজেকে আঘাত যুবকের। ৩০৯ ধারায় মামলা পুণে পুলিশের।
ডিসেম্বর, ২০২০: প্রাক্তন বিজনেস পার্টনারের অফিস তছনছ করে আত্মহত্যার চেষ্টা। আহত প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধে ৩০৯ ধারা পুনে পুলিশের।
কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের মতে, এর মূল কারণ আইনি বিভ্রান্তি। ‘‘আসলে মেন্টাল হেলথকেয়ার অ্যাক্ট ২০১৭ লাগু হয়ে গেলেও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৯ নম্বর ধারাটি কিন্তু রয়েছেই। তাই আত্মহত্যার চেষ্টাকে পুরোপুরি অপরাধের তকমামুক্ত করতে হলে ৩০৯ নম্বর ধারা বাতিল বা বিলোপ করা দরকার’’, স্পষ্ট বক্তব্য আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
২০১৪-য় কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে জানিয়েছিল, অন্তত ১৮টি রাজ্য ৩০৯ নম্বর ধারা বাতিলের পক্ষে। কিন্তু তার পরও ধারাটি রয়ে যায়। অন্য দিকে, নতুন মানসিক স্বাস্থ্য আইন বলবৎ হয়ে যায় ২০১৮ সালে। এবার প্রশ্ন তৈরি হয়: আত্মহত্যার চেষ্টা অপরাধ নাকি নয়?
কে কী ভাবে আইনের ব্যাখ্যা করছেন, এক্ষেত্রে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আইনজীবী মহল। ‘‘একই বিষয়ে যদি জেনারেল ল’ এবং স্পেশ্যাল অ্যাক্ট দু’টিই থাকে, তা হলে স্পেশ্যাল অ্যাক্ট প্রাধান্য পায়। আবার কোনও বিষয়ে একটি পুরনো আইন ও একটি নতুন আইন থাকলে নতুন আইনের প্রাধান্য পাওয়ার কথা। দু’টি ব্যাখ্যা অনুযায়ীই আত্মহত্যার চেষ্টাকে ২০১৭-র মানসিক স্বাস্থ্য আইনের আলোয় দেখা উচিত’’, বলছেন আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত।
তবে ৩০৯ নম্বর ধারাটি যে সমস্যা তৈরি করতে পারে, সে কথাও মানছেন কৌশিক। কারণ আত্মহত্যার চেষ্টাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে ওই ধারায়।
কী রকম? ৩০৯ নম্বর ধারা রেখে দেওয়ার পক্ষে যাঁরা সওয়াল করেন তাঁদের অনেকের যুক্তি, সকলেই যে তীব্র মানসিক চাপে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এমন ধরে নেওয়ার কারণ নেই। দাবি আদায়ের জন্যও এমন পথ বেছে নেন অনেকে। অভিযোগ, এসব ক্ষেত্রে ATTEMPT TO SUICIDE-কে MANIPULATION-এর কৌশল ধরে ৩০৯ নম্বর ধারায় ব্যবস্থা নিতে চায় পুলিশ-প্রশাসন।
এ যুক্তির সবটাই পত্রপাট উড়িয়ে দিলেন মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনকর্মী রত্নাবলী রায়। বললেন, ‘‘ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ নিষ্ক্রিয় হলেও কোথাও অতিসক্রিয়। আর এই অতিসক্রিয়তা নির্ভর করে রাজনৈতিক অভিসন্ধির উপর।’’
আইনজীবী দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘শতকরা আটানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে প্রসিকিউশনই আইনের অপব্যবহার করছে, বাকি দু’শতাংশে হয়তো অন্য পক্ষ সুযোগ নেয়।’’
আইনের অপব্যবহার, MANIPULATION—এই ছাঁচে আত্মহত্যার চেষ্টার মতো ঘটনাকে দেখতেই নারাজ আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত। ‘‘যদি কেউ দাবি আদায়ের জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে পিছপা না হন, তা হলে সেটিকে MANIPULATION-এর কৌশল ভাবতে আমি অন্তত রাজি নই। বরং সেটি তাঁর চূড়ান্ত অসহায়তার প্রমাণ, তীব্র মানসিক চাপের প্রকাশ। বিষয়টি বুঝতে হলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশাসনের প্রশিক্ষণ জরুরি’’, রাখঢাকহীন বক্তব্য কৌশিকের।
২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভারতের যত সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা উঠে এসেছিল, ২০২০-র মার্চ-এপ্রিলে তা বেড়ে যায় ৬৭ শতাংশ।
একাংশের ব্যাখ্যা, অতিমারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধাক্কাতেই এমন বাড়বৃদ্ধি।
বাস্তবিক। এ দেশে মানসিক স্বাস্থ্য, অসুস্থতা, আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টার মতো শব্দের সঙ্গে এখনও কয়েক মেট্রিক টন ছুৎমার্গ মিশে রয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে বহু মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণার কথা আমি-আপনি লুকিয়ে যাই। তার উপর আবার আইনি বিভ্রান্তি। সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা! তাই কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার আগে ‘পুলিশের দিকটা সামলানোর কথা’ মনে পড়ে পরিজনদের।
তবে WHO-র হুঁশিয়ারি মাথায় রাখলে উল্টোটাই হওয়ার কথা প্রথমে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র মতে, PREVIOUS ATTEMPT TO SUICIDE-ই SUICIDE-এর সবচেয়ে বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির মনোচিকিৎসক সুজিত সরখেলের মতে, ‘‘প্রথম বার আত্মহত্যার চেষ্টার পরই চিকিৎসা শুরু হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জীবনের দিকে ফেরানো সহজ। না হলে ফের নিজেকে শেষ করার চেষ্টা করতে পারেন তিনি।’’
এক্ষেত্রে এ দেশের ছবিটা বিশেষ ভাবে উদ্বেগজনক। একটা ছোট পরিসংখ্যান দেখা যাক। ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ভারতের যত সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা উঠে এসেছিল, ২০২০-র মার্চ-এপ্রিলে তা ৬৭ শতাংশ বেড়ে যায়। একাংশের ব্যাখ্যা, অতিমারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধাক্কাতেই এমন বাড়বৃদ্ধি। ছবিটা যাতে আরও মর্মান্তিক না-হয়, তাই প্রথম বারেই আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা নজরে আনা জরুরি। সে জন্য আইনি বিভ্রান্তি কাটানো দরকার, মত বিশেষজ্ঞমহলের।
তবে সুইসাইড-কে শুধুমাত্র মেডিকো-লিগাল জটের সমস্যা বলে দেখতে চান না রত্নাবলী রায়। বললেন, ‘‘মূল সমস্যাটা সামাজিক বঞ্চনার। এর প্রতিবিধান লুকিয়ে সামাজিক ন্যায়ে। তাই সুরাহা খুঁজতে শুধু মনোচিকিৎসার আশ্রয় নিলে হবে না। সামাজিক ন্যায়ে প্রতিকার খুঁজতে হবে।’’
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
আরও পড়ুন, World Suicide Prevention Day: প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যা একজনের, রোধের উপায় কী-কী?