
কোভিড মহামারীর পর কি আরও বড় স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জরুরি অবস্থার মুখে ভারত? এই আশঙ্কা-ই করছেন চিকিৎসকরা। উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁরা জানাচ্ছেন, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতীয়দের একটা বড় অংশ। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়সই ৩০-এর নিচে। সাধারণভাবে সংক্রমণ ঘটে না এমন তিনটি রোগের ত্রিফলা আক্রমণে ছারখার হয়ে যেতে পারে প্রায় ৫০% ভারতীয়র জীবন। যার প্রভাবে নেমে আসতে পারে ঘোরতর অর্থনৈতিক সংকটও। এই ভাষাতেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে, জরুরি ভিত্তিতে দেশজুড়ে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করলেন পদ্ম পুরস্কার বিজয়ী দেশের সবচেয়ে নামী ও সম্মানীয় চিকিৎসকদের একটি দল।
Pacific OneHealth session, 2025-এর আলোচনায় উঠে এল মূলত তিনটি ‘নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ’ বা NCD-র প্রসঙ্গ। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, দেশজুড়ে কয়েক কোটি পরিবার এই তিন রোগের ত্রিফলা আক্রমণে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে পারে। পরিবারের মূল উপার্জনকারী মারা যেতে পারেন, সন্তানরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়তে পারে। বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবাও। একসঙ্গে এত মানুষ মারা যেতে পারেন যে, নড়ে যেতে পারে ভারতীয় অর্থনীতির ভিত-ও। ICMR ও WHO-এর দেওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই এই আশঙ্কা করছেন দেশের সবচেয়ে বড় ও নামী চিকিৎসকেরা। এর আগে একসঙ্গে এতজন চিকিৎসক এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তার নজির নেই বললেই চলে।
কী কী এই তিনটি রোগ?
চিকিৎসকদের বক্তব্য,
১. ডায়াবেটিস
২. হার্টের রোগ ও
৩. ক্যান্সার
এই তিনটি রোগ কার্যত নিঃশব্দে ভারতের ঘরে ঘরে অনুপ্রবেশ করেছে। এখনই রাশ টানতে না পারলে দ্রুতই এই তিন রোগ মহামারীর আকার নিতে পারে। তখন তার ভয়াবহতার সামনে কোভিড মহামারীকেও শিশু বলে মনে হবে। দেশজুড়ে প্রতিদিন সবমিলিয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ৬৬%-ই হয় এই তিন রোগে। স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের চেয়ারম্যান পদ্মশ্রী ডাক্তার ডি এস রানা-র আশঙ্কা, এখনই দেশের সব নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু স্বাস্থ্য পরিষেবার বন্দোবস্ত না করতে পারলে ভবিষ্যতে দেশজুড়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়তে পারে। গরিবের জন্য সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যে দুর্নীতি রুখতে এখনই কড়া হতে হবে প্রশাসনকে। নইলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। সকলের জন্য বিনামূল্যে বা সুলভে, সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিষেবা ব্যবস্থার পক্ষে জোরাল সওয়াল করেন পদ্মশ্রী এই চিকিৎসক।
আরেক বিশিষ্ট চিকিৎসক, পদ্মশ্রী ডাক্তার প্রবীণ চন্দ্র বলেন, যেহেতু হার্ট-ই বেশিরভাগ রোগের সহজ ‘গেটওয়ে’, তাই হার্ট ভাল রাখাটা সবচেয়ে জরুরি। হার্টের ক্ষতি করে এমন সব অভ্যাস, খাবার অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। হার্টের অসুখকে হেলাফেলা করলে চলবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। আজ ভারতে প্রযুক্তির উন্নতির কারণে, ৮০ বা ৯০ বছর বয়সী রোগীদেরও অনেকরকম জটিল কার্ডিয়াক অপারেশন করা যায় বলেই তাঁর মত। ভারতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে শিশুরা কেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে, এই প্রসঙ্গও উঠে আসে আলোচনায়। চিকিৎসকরা মূলত দুটি কারণকে ‘ভিলেন’ বলছেন। অতিরিক্ত টেনশন ও বাজে খাবারের প্রতি ঝোঁক। কেন শিশুদের প্রতিদিনের খাবারে মাত্রাতিরিক্ত চিনি ও নুন থাকবে? এই প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকরা। অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, কম ঘুম, ব্যায়ামে অনীহা ও হাইপার টেনশন আজ ৩০ কোটিরও বেশি ভারতীয়কে প্রভাবিত করেছে বলে উঠে এসেছে চিকিৎসকদের দেওয়া পরিসংখ্যানে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ ও কিশোর।
হার্টের পাশাপাশি চিকিৎসকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ডায়াবেটিস নিয়েও। তাঁদের কথায়, ‘ভারত আজ গোটা বিশ্বে ডায়াবেটিসের রাজধানী।’ বিশিষ্ট চিকিৎসক পদ্মশ্রী অনুপ মিশ্র জানিয়েছেন, শুধু দিল্লিতেই প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আরও ৩০% প্রি-ডায়াবেটিক। অনেকে এটা নিয়ে গর্ব করেন। সেটা একেবারেই ভুল। আজ কম বয়স থেকেই রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি বলে দাওয়াই দিয়েছেন ডাক্তার মিশ্র। সঠিক সময়ে রোগ নির্ধারণ, যথাসময়ে পরামর্শ মেনে ওষুধ ও লাইফস্টাইলে একটু ভারসাম্য আনতে পারলেই কম বয়সে ডায়াবেটিসের প্রবণতা রুখে দেওয়া সম্ভব বলেও জানিয়েছেন এইমসের এই প্রাক্তন অধ্যাপক। হাইপারটেনশন ও ওবেসিটি আজ মহামারীর আকার নিয়েছে। সরকারি তথ্য বলছে, প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন ভারতীয় উচ্চরক্তচাপজনিত রোগ ও প্রায় ২৫৪ মিলিয়ন ভারতীয় ওবেসিটিতে আক্রান্ত। শিশুরাও এর বাইরে নয়।
আর ক্যান্সার? রাজার রোগের বহরও রাজার মতোই। ২০৪০-এর মধ্যে দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭%-এরও বেশি বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের। আলোচনায় উঠে এসেছে, ক্যান্সার আজ একটি সচল ‘টাইম বোমা’। শুধুমাত্র ২০২২-এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন ভারতে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই তামাক সেবনের কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। সিগারেট, গুটখা ও খৈনির মতো তামাকজাত পণ্য এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎকরা। তাঁরা এটাও স্বীকার করছেন, এ দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, সেই চিকিৎকসা করাতে গিয়েও অনেক পরিবার আর্থিক দিক থেকে সর্বস্বান্ত হয়। দেশের সব হাসপাতালকে ‘নন-প্রফিট’ বা ‘অলাভজনক’ করতে পারলে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে, বলছেন বিশিষ্টরা। আধুনিক স্বাস্থ্য পরিষেবা যে আজ দেশের গুটিখানেক প্রিভিলেজ ক্লাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ-এই কঠিন সত্যি কথাটাও বারবার উঠে এসেছে আলোচনায়। ২০৩০-এর মধ্যে এই তিন রোগের ত্রিফলা আক্রমণের ফলে ভারতের প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হবে বলেও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। ৬২% পরিবারকে চিকিৎসার জন্য ঘটিবাটি বেচতে হতে পারে, অনেকে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়বেন বলেও আশঙ্কা। আশার কথা, নরেন্দ্র মোদী সরকার আসন্ন জিএসটি বৈঠকে স্বাস্থ্য ও জীবনবীমা থেকে জিএসটি কমালে সাধারণ মানুষের একটু সুরাহা হতে পারে। রোগকে তো আটকানো যায় না, অন্তত পর্যাপ্ত চিকিৎকসাটুকু মিললেও অনেকে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, অনেক পরিবার বেঁচে যেতে পারে।
একনজরে কী কী উঠে এল Pacific OneHealth session, 2025-এর আলোচনায়