
পহেলগাঁও হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে গোটা বিশ্ব জুড়ে। ভারতের বৈসরান উপত্যকায় পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলাযর দায় স্বীকার করেছে রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। যা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা সংগঠন বলে মনে করা হয়। ভারতে এই সন্ত্রাস হামলার পিছনে পাকিস্তানের ইন্ধন রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা রদের পরে যে বিদ্রোহের আগুন দেখা গিয়েছিল এই হামলা তারই অংশ। যদিও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত বলছে অন্য কথা। তাঁদের মতে এই হামলার বীজ পোঁতা হয়েছিল এক দশক আগে। কী বলছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর রিপোর্ট?
১৯৯৩ সালের একটি গোপন অ্যাসেস্টমেন্ট রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ্যে এনেছে সংস্থা। কী আছে সেই রিপোর্টে? পাকিস্তান যে ভারতকে ভয় পায় তাও রয়েছে সেই রিপোর্টে। কেবল অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক থেকে নয়, অস্তিত্বগত দিক থেকেও। জাতীয় গোয়েন্দা অনুমান (এনআইই) নামক এই নথিতে ভারত-পাকিস্তানের গতিশীলতা অধ্যয়ন করা হয়েছে। সেই রিপোর্ট অনুসারে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে সম্ভবত কাশ্মীরের মতো কিছু কারণে তা শুরু হবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান শুরু থেকেই পিছিয়ে থাকবে।
NIE তৈরি করা হয়েছিল সিআইএ-র এক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ব্রুস রিডেলের নেতৃত্বে। সে সময়ে ভারতে সদ্য ঘটে গিয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা। পাকিস্তানও তখন দেশের অভ্যন্তরে নানা বিষয় নিয়ে জর্জরিত। তারই সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল একটি নীরব হুমকি।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা সিআইএ-এর মতে ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ, ‘২০ শতাংশ’। কিন্তু যা তাঁদের কপালে ভাঁজের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা হল ‘চেইন রিঅ্যাকশন’। ঝামেলায় উস্কানি, প্রতিশোধমূলক মনোভাব। কোনও বড় সন্ত্রাসী ঘটনা, সামরিক মহড়া নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, অথবা হঠাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাকে ট্রিগার করতে পারত যে কোনও মুহূর্তে।
ওই নথির তথ্য অনুসারে ভারত বা পাকিস্তান কেউই যুদ্ধ চায়না। কিন্তু ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে আটকাতে ভয় থেকে পাকিস্তান কোনও বড় পদক্ষেপ নিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরে প্রক্সি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করা অথবা ভারতের প্রভাব কমাতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জোট গঠন করার মতো ঘটনা।
ঔই প্রতিবেদনে টিআরএফের নাম উল্লেখ করা হয়নি। সেই সময় এই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল না। তবে ‘কাশ্মীর মুক্ত করার’ জন্য ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাকিস্তানের কৌশল সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল।
পাকিস্তানের কৌশলগত ভয় –
সিআইএ রিপোর্টের মূলে ছিল ইসলামাবাদের জন্য একটি অস্বস্তিকর সত্য। আসলে ক্ষমতার ভারসাম্য তখনই ভারতের পক্ষে ঝুঁকে পড়ছিল। অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিকভাবে নয়াদিল্লির উত্থান ছিল ঈর্ষনীয়। কেবল যুদ্ধশক্তিতে নয় অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও অনেক শান্ত ছিল ভারত।
ভারতের অভ্যন্তরীণ সকল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, স্থিতিশীল সরকার এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ছিল মূল শক্তি। সেই সময় ভারতের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন ডঃ মনমোহন সিং।
পাকিস্তান সামরিক শাসন, রাজনৈতিক সংকট এবং অর্থনৈতিক ভাঙ্গনের মধ্যে দোদুল্যমান ছিল। আস্থা নয়, ভয়ই তাদের কাশ্মীর নীতিকে চালিত করেছিল।
সিআইএ-র মূল্যায়নে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন পাকিস্তানকে পারমাণবিক মোতায়েনের দিকে ঠেলে দিতে পারে অথবা অসম যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এর মধ্যে সন্ত্রাসবাদও অন্তর্ভুক্ত ছিল – কম খরচের, উচ্চ-প্রভাবশালী অভিযান যা প্রকাশ্য সংঘর্ষ ছাড়াই ভারতকে রক্তাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল।
১৯৯৩ সালের নথিতে এও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে যদি অর্থনৈতিক পতন ঘটে, অথবা কোনও সামরিক স্বৈরচারী শাসক পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে, তাহলে পাকিস্তান জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে এবং ভারতকে উত্তেজিত করতে জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যদি ধর্মীয় মেরুকরণের আধিপত্য থাকে, তাহলে তা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাকে আরও উস্কে দিতে পারে বলেও জানানো হয়েছিল সেই রিপোর্টে। ফলে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ আরও সহজ হয়ে উঠবে।