Exclusive: ‘ওরা ইনসান নয়, হিন্দু-মুসলিম তো পরের কথা!’ শ্রীনগর থেকে খোলাচিঠি মহম্মদ সফি খানের
কিছুটা দুশ্চিন্তায়, কী হবে এরপর? ঠিক তখনই টিভি ৯ বাংলা ডিজিটাল থেকে ফোন। জানতে চাইল, বইসরনের হত্য়াকাণ্ড নিয়ে আমরা কাশ্মীরিরা কী ভাবছি, কী আমাদের অনুভূতি। বুঝতেই পারছিলাম না কী উত্তর দেব। ডাললেকের দিকে ঘুরে তাকালাম। শিকারাগুলো তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে।

শ্রীনগর জুড়ে চড়া রোদ। ডাললেকের জল এতটাই চিকচিক করছে যে, টলটলে জলের দিকে চোখ রাখা যাচ্ছে না। সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে রঙিন শিকারা। চারপাশে থমথমে ভাব। জায়গায় জায়গায় অল্প কিছু লোকজন জড়ো হয়ে আলোচনায় মত্ত। তাঁদের চোখে মুখেও টেনশন। ব্যক্তিগত কাজেই ডাললেকের পাশটায় গিয়েছিলাম। রাস্তা পুরো ফাঁকা। সেনাবাহিনীর টহল অবশ্য চলছে। সোমবারের চিত্রটা ছিল পুরো উল্টো। শ্রীনগরের নয়নের মণি ডাল লেকে টুরিস্টের কলরবে কান পাতা দায়। শাম্মি- শর্মিলার আদলে, দিওয়ানা হুয়া বাদল গানে শিকারায় চড়ে কত ছবি, কত ভিডিও। কাওয়া, ফালুদার গন্ধে ম ম করছিল ডাল লেকের আসপাশ। তবে মঙ্গলবার বইসরনে হত্যাকাণ্ডের খবর উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়তেই দুম করেই চিত্রবদল। সেই কলরবও আর নেই। সেই গন্ধও নেই। বরং দোকান-পাট বন্ধের মাঝে প্রতিবাদের মিছিল। ‘টুরিস্ট হামারি জান হে, টুরিস্ট ভগবান হে…’। এই চিত্র বহুদিন বাদে শ্রীনগরে চোখে পড়ল। তাই কিছুটা দুশ্চিন্তায়, কী হবে এরপর? ঠিক তখনই টিভি ৯ বাংলা ডিজিটাল থেকে ফোন। জানতে চাইল, বইসরনের হত্য়াকাণ্ড নিয়ে আমরা কাশ্মীরিরা কী ভাবছি, কী আমাদের অনুভূতি। বুঝতেই পারছিলাম না কী উত্তর দেব। ডাললেকের দিকে ঘুরে তাকালাম। শিকারাগুলো তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে।
একসময় ব্যবসার কারণে কলকাতায় আমার নিত্য যাওয়া-আসা ছিল। তবে কয়েকবছর হল সেই ব্যবসার পাট গুটিয়ে শ্রীনগরের পুরনো বাড়িতেই রয়েছি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে কলকাতার কত মানুষ এই ভূস্বর্গ ঘুরেছেন তার হিসেবে রাখিনি। এখনও ফোনে কথা হয়। কুশল বিনিময় হয়। অনেকে তো এতবার এই কাশ্মীরে এসেছেন যে, শ্রীনগরের অলিগলি তাঁরা আমার থেকেও ভাল চেনেন। কিন্তু তাঁরাই এখন কাশ্মীরে আসতে ভয় পাচ্ছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কাশ্মীরের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরাই ভয় পাচ্ছি। পহেলগাঁওয়ের হত্যালীলার কথা ভাবলেই শিউরে উঠছি।
ডাললেকের পাশে যখন দাঁড়িয়ে তখনই বুঝতে পারছিলাম, যে পর্যটকরা এসেছেন, তাঁরা বাড়িতে ফেরার জন্য ছটফট করছেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ছেন বিমানবন্দর বা বাসস্টপের দিকে। বহু বছর পর মানুষ ভয় কাটিয়ে উপত্যকায় পা রেখেছিল, সেই ভয়ই ফের ফিরিয়ে দিল বইসরনের এই হত্যালীলা। এই অন্যায়ের কোনও ক্ষমা নেই। কীসের হিন্দু, কীসের মুসলিম! ওদের পরিচয় শুধুই জঙ্গি। কাশ্মীরি মানুষররা মহেমানদের ধর্ম নিয়ে কখনও ভাবে না। আমাদের হৃদয়, আমাদের বাড়ি সব সময়ই তাঁদের জন্য খোলা। কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে গুলিবর্ষণও হয়েছে, কিন্তু পর্যটকদের উপর হামলা, হত্যা আগে কখনই দেখিনি। যারা এটা করেছে, তারা আসলে কাশ্মীরকে ভিতর থেকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। না হলে, যে পর্যটকদের হাত ধরে কাশ্মীরের অর্থনীতি চলছে, সেখানে আঘাত হানল! ঘেন্না হচ্ছে ওদের উপর। মনুষত্ব যদি চলে যায়, তাহলে মানুষ আর শয়তানের মধ্যে কোনও তফাৎ থাকে না। ওরা প্রমাণ করেছে, ওরা ইনসান নয়, হিন্দু-মুসলিম তো পরের কথা। যাঁরা পরিবারকে হারিয়েছেন, তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনও শব্দ নেই। উপত্যকার গায়ে রক্ত লেগেছে, জানি না সেটা কীভাবে মোছা যাবে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, কাশ্মীরে শীঘ্রই শান্তি ফিরুক। ডাললেকের জলে ফের নিশ্চিন্তে চলুক শিকারা।
লেখক মহম্মদ সফি খান শ্রীনগরের বাসিন্দা। পেশায় ওষুধ বিক্রেতা। ব্যবসার কাজে কলকাতাতেও বহুদিন থেকেছেন।
অনুলিখনে আকাশ মিশ্র
This content contains news and analysis related to a recent terror attack in Kashmir. The content may include sensitive visuals and discussions that could be distressing to some readers. Readers discretion is advised. We strongly condemn all forms of violence and terrorism. The purpose of this content is solely to inform and create awareness based on verified reports.
