Bishnoi Movement: লরেন্সের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস: ৩০০ বছর আগে গাছ বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছিল বিষ্ণোইদের ৩৬৩ জন
Bishnoi Movement: অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেন হঠাৎ তিন দশক আগের কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার জন্য এখন সলমন খানকে নিশানা করছে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং? আসলে অনেকেরই হয়তো জানা নেই, আজ থেকে ৩০০ বছর আগে, লরেন্স বিষ্ণোইয়ের পূর্বপুরুষরাও কিন্তু গাছ কাটা আটকাতে বিনা দ্বিধায় প্রাণ দিয়েছিলেন। গ্যাংস্টার হলেও, সেই উত্তরাধিকারই আজ পর্যন্ত বয়ে চলেছে লরেন্স বিষ্ণোই।
সম্প্রতি লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছেন মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা এনসিপি (অজিত পওয়ার গোষ্ঠী)-র নেতা, বাবা সিদ্দিকি। বিষ্ণোই গ্যাং জানিয়েছে তাদের মূল নিশানা হল বলি অভিনেতা সলমন খান। ১৯৯৮ সালে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের সময়, রাজস্থানে দুটি কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ উঠেছিল সলমনের বিরুদ্ধে। প্রাথমিকভাবে এই মামলায় সলমনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও, পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এই কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার কারণেই সলমন খান রয়েছেন বিষ্ণোই গ্যাংয়ের নিশানায়। এক সাক্ষাৎকারে, লরেন্স বিষ্ণোই বলেছিল, “আমরা টাকা চাই না। আমরা শুধু চাই তিনি (সলমন খান) আমাদের সম্প্রদায়ের মন্দিরে যান এবং আমাদের কাছে ক্ষমা চান। কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করে তিনি আমাদের সমগ্র সম্প্রদায়কে অপমান করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু, তিনি ক্ষমা চাইতে নারাজ।” অনেকেই এটা জেনে বিস্মিত হয়েছেন। মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেন হঠাৎ তিন দশক আগের ওই কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করছে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং? অনেকেরই হয়তো জানা নেই, আজ থেকে ৩০০ বছর আগে, লরেন্স বিষ্ণোইয়ের পূর্বপুরুষরাও কিন্তু গাছকাটা আটকাতে বিনা দ্বিধায় প্রাণ দিয়েছিলেন। গ্যাংস্টার হলেও, সেই উত্তরাধিকারই আজ পর্যন্ত বয়ে চলেছে লরেন্স বিষ্ণোই।
কারা এই বিষ্ণোই সম্প্রদায়?
বর্তমান বিশ্বে একটা শব্দবন্ধ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে, ‘ইকো-ওয়ারিয়র’, অর্থাৎ পরিবেশ-যোদ্ধা। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় এবং পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে ব্রতীদের এই নামে ডাকা হয়। বিষ্ণোই সম্প্রদায়কে বলা যেতে পারে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পরিবেশ-যোদ্ধা। হিন্দু সম্প্রদায়েরই একটি শাখা হল বিষ্ণোই। হিন্দু ধর্মের এই শাখা ২৯টি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যার বেশিরভাগই পরিবেশ রক্ষার কথা বলে। গত ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সম্প্রদায় পরিবেশ রক্ষার জন্য লড়াই করছে। বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা ১৫ লক্ষেরও বেশি। এদের অধিকাংশই রাজস্থান জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ – সকল প্রাণই তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। তাই এই সম্প্রদায়ের মাংস খাওয়া, গাছ কাটা নিষিদ্ধ।
কেন বিষ্ণোইরা গাছ এবং প্রাণী রক্ষা করে?
১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে, পশ্চিম রাজস্থানের মারওয়ারের মরুভূমি এলাকায়, এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গুরু মহারাজ জামবাজি। ওই এলাকার প্রায়ই খরা হত। সেই সময় পশুদের খাওয়ানোর জন্য অবিরাম গাছপালা কেটে ফেলত সেখানকার বাসিন্দারা। জামবাজি দেখেছিলেন, তাতে খরার মাত্রা আরও বাড়ছে এবং শেষ পর্যন্ত আরও বেশি মৃত্যু ঘটছে। এরপরই তিনি তাঁর ভক্তদের বোঝান, স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে বা প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে গাছকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এরপরই তিনি ওই ২৯টি অনুশাসন বা নিয়ম চালু করেছিলেন। যার প্রায় সবগুলিই প্রকৃতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত। তাঁর ভক্তরাও “সকল জীবের প্রতি করুণাময় হতে এবং তাদের ভালবাসাতে এবং সজীব গাছ না কাটতে” সম্মত হন। প্রকৃতির প্রতি জামবাজির এই আধ্যাত্মিক শ্রদ্ধার ফলে, শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চলের মাঝখানে এক সবুজ ভূমি গড়ে উঠেছিল। সেই থেকেই বিষ্ণোইরা গাছপালা এবং প্রাণীদের যত্ন নেওয়া এবং পানীয় জল সংরক্ষণ করে।
পরিবেশ রক্ষায় শহিদ ৩০০ বিষ্ণোই
গুরু জামবাজির এই ২৯টি নীতি লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রায় ৩০০ বছর পর, ১৭৩০ সালে বিষ্ণোই সম্প্রদায় তাদের প্রকৃতি প্রেমের সবথেকে বড় পরিচয় দিয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, যোধপুরের মহারাজা একটি নতুন প্রাসাদ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সিমেন্ট-চুনের ভাটায় জ্বালানির জন্য এবং প্রাসাদের দরজা-জানালা তৈরির জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োজন ছিল। মহারাজের নির্দেশে, খেজারলি গ্রামের কাছে এক বনাঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল রাজার সৈন্যরা। খেজারলি গ্রাম ছিল বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের গ্রাম। পাশের বনে ওই গ্রামবাসীরাই প্রচুর পরিমাণে বাবলা গাছ লাগিয়েছিল এবং পালন করেছিল। রাজার সৈন্যরা ওই গাছগুলি কাটতে আসলে, প্রতিবাদ করেছিল বিষ্ণোইরা। সৈন্যদের পদক্ষেপ শুধুমাত্র তাদের গ্রামের পবিত্র গাছই ধ্বংস করছিল না, আঘাত লেগেছিল তাদের ধর্ম-বিশ্বাসেও।
কিংবদন্তি অনুসারে, অমৃতা দেবী নামে গ্রামের এক মহিলা সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর তিন মেয়ে ছিলেন। রাজার সৈন্য যখন গাছ কাটতে উদ্যত, তখন তাদের আটকাতে, অমৃতা দেবী তাঁর তিন মেয়েকে নিয়ে গাছগুলিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তিনি অন্য গ্রামবাসীদেরও তা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন, “কাটা গাছের থেকে কাটা মাথার দাম কম।” এরপর, শুধু খেজারলি গ্রাম নয়, আশেপাশের গ্রাম থেকেও দলে দলে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের সদস্যরা সেখানে এসে একে-একে গাছগুলোকে আলিঙ্গন করতে শুরু করেন। যাতে, রাজার সৈন্যদের হাত থেকে গাছগুলিকে রক্ষা করা যায়।
কিন্তু, সৈন্যদের উপরে ছিল রাজার আদেশ। তাই, বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের ওই আচরণে তাদের মন গলেনি। গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ উপেক্ষা করেছিল তারা। তবে, গাছগুলি কাটার আগে বিষ্ণোই গ্রামবাসীদের শিরশ্ছেদ করতে হয়েছিল সেনাদের। সব মিলিয়ে ওই দিন খেজারলির বনে শহিদ হয়েছিলেন বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের ৩৬৩ সদস্য। যার মধ্যে মহিলা ছিল, পুরুষ ছিল, ছিল শিশুরাও। এই ঘটনার কথা মহারাজের কানে পৌঁছয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন ওই গ্রামে। ক্ষমা চেয়েছিলেন গ্রামবাসীদের কাছে। সৈন্যদের গাছ কাটাও সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই, যৌধপুরের মহারাজা বিষ্ণোই রাজ্যকে একটি সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ, সেখানে গাছ এবং প্রাণীর ক্ষতিসাধন নিষিদ্ধ করেছিলেন। এই আইন আজও ওই অঞ্চলে জারি রয়েছে।
ওই ৩৬৩ জন বিষ্ণোই শহিদের স্মরণে, ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি বাবলা গাছ রোপণ করা হয়েছিল। সেই গাছগুলি এখনও সেখানে রয়েছে বলে শোনা যায়। তাদের আত্মত্যাগকে গ্রামের এক স্মৃতিস্তম্ভেও ধরে রাখা হয়েছে। সেখানে ওই ৩৬৩ জনেরই নাম খোদাই করা আছে। আর স্মৃতিস্তম্ভটির উপরে রয়েছে অমৃতা দেবীর একটি মূর্তি।
আধুনিক যুগেও সেই মূল্যবোধ বহন করছেন বিষ্ণোইরা
আধুনিক যুগেও বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই তাদের পূর্বপুরুষদের দেখানো পথেই চলেন। বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই কৃষিজীবি। কোনও প্রাণীর যাতে ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা নিয়মিত জমিতে টহল দেয়। ‘বিষ্ণোই টাইগার ফোর্স’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছেন আইনজীবী রামপাল ভাওয়াদ। এই সংস্থা পরিবেশ রক্ষা এবং চোরাশিকার রোধে কাজ করে। এক সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, “আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা উচিত। সকলত জীবের প্রতি সদয় হওয়া উচিত। এটাই ভবিষ্যতে মানব জাতির আরও উন্নতি ঘটাবে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের সকলকে শৈশব থেকেই প্রকৃতিকে ভালবাসাতে শেখানো হয়। তাঁদের কাছে পশুরা সন্তানের মতো। অনাথ হরিণ শাবককে বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছেন, বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন মহিলাও আছেন অনেকে। শক্তি হলে, তাদের বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। হিন্দুধর্মের শাখা হলেও, বিষ্ণোইরা তাদের মৃতদেহকে দাহ করে না। কারণ, আগুন জ্বালানোর জন্য সেই গাছ কাটতে হবে। তাই তারা মৃতদেহ কবর দেয়। বিষ্ণোই গ্রামে আশ্রয় দেওয়া হয়, কৃষ্ণসার হরিণ, চিঙ্কারা, শকুন, তিতির, ময়ূরের মতো বিপন্ন প্রাণীদের। চোরাশিকারিদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করে বিষ্ণোইরা।
চিপকো আন্দোলন
১৭৩০ সালের সেই বিষ্ণোই আন্দোলনই, স্বাধীন ভারতে বৃহত্তর চিপকো আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ছিল। গত শতাব্দীর সাতের দশকে, উত্তরাখণ্ড সাক্ষী হয়েছিল চিপকো আন্দোলনের। চিপকো আন্দোলন ছিল একটি সামাজিক-পরিবেশগত আন্দোলন। গাছ কাটা প্রতিরোধে এক অনন্য অহিংস পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন গ্রামবাসী ও পরিবেশ সংরক্ষণকামীরা। এই আন্দোলনের দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল – বনাঞ্চলে ব্যক্তিগত কারখানা নির্মাণ প্রতিরোধ করা এবং বন উজাড়ের হাত থেকে বনকে রক্ষা করা। গাছ কাটা আটকাতে আন্দোলনকারীরা জড়িয়ে ধরেছিলেন গাছকে। এই আন্দোলনে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ২০০১ সালে, অমৃতা দেবীর সম্মানে একটি জাতীয় পুরস্কার চালু করে সরকার। পরিবেশ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ‘অমৃতা দেবী বিষ্ণোই বন্যপ্রাণ সুরক্ষা পুরস্কার’ দিয়ে।
শেষ কথা
১৯৯৮ সালে, যখন সলমন খানের বিরুদ্ধে কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ উঠেছিল, তখন লরেন্স বিষ্ণোই ছিলেন শিশু। কিন্তু, ছোট থেকেই প্রাণী ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের শিক্ষা পায় বিষ্ণোইরা। কাদেই ওই সময় থেকেই সলমন খানের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল লরেন্সের। তাই, গ্যাংস্টার হওয়ার পর, সলমনই হয়ে উঠেছেন তার জীবনের প্রধান টার্গেট।