
নয়া দিল্লি: দেশে শক্তি ক্ষেত্রে আসতে চলেছে বিরাট পরিবর্তন। লোকসভায় গত ১৫ ডিসেম্বর মোদী সরকার পেশ করল সাসটেইনেবল হারনেসিং অব অ্যাটোমিক এনার্জি ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া ওরফে শান্তি (SHANTI) বিল। একদিকে এই বিল পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে (nuclear energy sector) বেসরকারি সংস্থাগুলির প্রবেশের পথ খুলে দিচ্ছে, আরেকদিকে আবার এমন শক্তির দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
ভারতে পরমাণু কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে, সরবরাহকারী বা সাপ্লায়ারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের কঠোর আইন ছিল। সেই আইন বাতিল হয়ে যাবে এই বিল পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে। অন্যদিকে, এতদিন পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানই কাজ করত। এবার বেসরকারি ক্ষেত্রও প্রবেশ করবে পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে। তবে অবশ্যই পথটা এত মসৃণ নয়। ইতিমধ্যেই বিরোধিতার সুর চড়িয়েছে বিরোধী দলের সাংসদরা। তাদের দাবি, ভারতের পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে প্রাইভেট কোম্পানিগুলির প্রবেশ কেবল তাদেরই লাভ করতে সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষের কোনও উপকারই হবে না, যাদের বিদ্যুতের বিপুল খরচ বহন করতে হয়।
ইন্ডিয়া জোটের সাংসদরা বিরোধিতায় ওয়াক আউট করে। তাদের দাবি ছিল এই বিল জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি বা স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হোক। তবে ইন্ডিয়া জোটের অনুপস্থিতিতে লোকসভায় ধ্বনি ভোট পাশ হয়ে যায় এই শান্তি বিল।
এই বিল আনার কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে দেশের শক্তি ক্ষেত্রকে আরও মজবুত করতে বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির দরজা খুলে দেওয়া হবে। এই বিল ভারতের পরমাণু ক্ষেত্রে বিল, অ্যাটোমিক এনার্জি অ্যাক্ট ১৯৬২ ও সিভিল লায়েবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ অ্যাক্ট ২০১০-কে প্রতিস্থাপিত করবে। এই বিল আইনে পরিণত হলে আমেরিকার কোম্পানিগুলির কাছে ভারতে ব্যবসার দরজা খুলে দেবে। এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনও ট্যারিফ চাপাচ্ছেন, কখনও আবার সুর নরম করে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা এগোচ্ছেন।
২০১০ সালে যখন সিভিল লায়েবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ অ্যাক্ট আনা হয়, তখন বিজেপি এই আইনের দুটি বিধানের বিরোধিতা করেছিল। প্রথম, ১৭(বি) ধারা, যেখানে কোনও ধরনের পরমাণু সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটলে, অপারেটর যেমন ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন, তেমনই সরবরাহকারী বা তার কর্মীরা যদি নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে, তাহলে তাদের থেকে সেই ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, ওই আইনের ৪৬ ধারায় বলা হয়েছিল যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের অপারেটররাও দায়বদ্ধ থাকবে। আহত বা নিহতের পরিবার চাইলে তাদের ক্ষতির জন্য মামলাও করতে পারবে।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ২০১০ সালের Civil Liability for Nuclear Damage Act (CLNDA) সংক্রান্ত কিছু বিতর্কিত ধারা নিয়ে একটি FAQ প্রকাশ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, মার্কিন সরকারের সেই দাবি মেটানো, যেখানে তারা এই আইনের কিছু ধারাকে শিথিল করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চাপ দিচ্ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল এমন কিছু ধারা ছিল যেগুলি পারমাণবিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরবরাহকারী কোম্পানিকেও দায়ী করতে পারে। মার্কিন পারমাণবিক সরবরাহকারী সংস্থাগুলি এই কারণে ভারতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না। আইন পরিবর্তন করা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হওয়ায়, ভারত সরকার আইন অপরিবর্তিত রেখে, FAQ-এর মাধ্যমে ওই ধারাগুলির ব্যাখ্যাকে সীমিত বা নরম করার চেষ্টা করে।
এরপরই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা করেন যে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড় ধরনের সমঝোতা হয়েছে, যা এতদিন দ্বিপাক্ষিক অসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শান্তি বিলে আমেরিকার পরমাণু সরবরাহকারীদের খোলাছুট দিল ভারতের পরমাণু শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে প্রবেশের। কোনও দুর্ঘটনায়, তা সে বিকল বা ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রের কারণে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেও, সংস্থাগুলি দায়ী থাকবে না। বরং এই বিলে বলা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকার, বোর্ড বা ট্রাইবুনাল কিংবা ক্লেম কমিশনের অধীনে কোনও মামলা থাকলে, দেওয়ানি আদালত কোনও মামলা গ্রহণ করতে পারবে না।
এই বিল নিয়ে একাধিক বিরোধী সাংসদই প্রশ্ন তুলেছেন। কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারি সরাসরি পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রবেশে আপত্তি না জানালেও, সরবরাহকারীদের দায় গ্রহণ এবং অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ডের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বলেছেন, যার উল্লেখ এই বিলে স্পষ্টভাবে নেই। তিনি প্রশ্ন করেন, “যেহেতু আমরা বিদেশি সরবরাহকারীদের উপরে নির্ভরশীল, যদি পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সরবরাহকারীদের দায়ী করা উচিত নয় কি?” তিনি এই প্রশ্নও তোলেন যে একটি বেসরকারি সংস্থা পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে নিজেদের কাজ শুরুর ঘোষণার পরই কেন সরকার এই বিল আনছে। যদিও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জীতেন্দ্র সিং, যিনি এই বিল পেশ করেছিলেন, তিনি এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেই উল্লেখ করেন।
কংগ্রেসের আরেক সাংসদ শশী থারুর এই বিলকে আক্রমণ করে বলেন, এটা নিউক্লিয়ার নয়, আন-ক্লিয়ার ও ডেঞ্জারাস বিল। তিনিও জেপিসিতে এই বিল পাঠানোর কথা বলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সৌগত রায়ও দেশের পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলির প্রবেশের বিরোধিতা করেন। তিনি দায়বদ্ধতার সীমাও বৃদ্ধি করার দাবি করেন। সিপিআই (এমএল) সাংসদ সুদামা প্রসাদ এই বিলকে জনগণ বিরোধী ও পরিবেশ বিরোধী বলে উল্লেখ করেছেন। সরকার কেন বেসরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগের পথ খুলে দিচ্ছে-এই প্রশ্ন তুলে বলেন যে এতে একচেটিয়া ব্যবসার সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে, বিজু জনতা দলের সাংসদ রবীন্দ্র নারায়ণ বেহরা কেন্দ্রের এই বিলে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এতে সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের খরচ অনেক কমবে।