Bharatiya Nyaya Sanhita: শিব ঠাকুরের আপন দেশে নতুন কানুন কি সর্বনেশে?

Aug 16, 2024 | 12:49 PM

ভারতবর্ষে ১ জুলাই থেকে চালু হয়েছে নতুন আইন। যা সত্যই সব্বনেশে কি না তা নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। এনডিএ সরকারের আমলে দেশের 'ঔপনিবেশিক' তিনটি আইনের অবলুপ্তি ঘটেছে। পুরনো আইনি ব্যবস্থার সঙ্গে নতুন ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এল, কেন এই পরিবর্তন করা হল, কোন বিষয়গুলি বেশি গুরুত্ব পেল- এ সব নিয়েই টিভি৯ বাংলা ডিজিটালের এই বিশেষ প্রতিবেদন।

Bharatiya Nyaya Sanhita: শিব ঠাকুরের আপন দেশে নতুন কানুন কি সর্বনেশে?
ভারতবর্ষে ১ জুলাই থেকে চালু হয়েছে নতুন আইন। যা নিয়েই এখন আলোচনা চলছে সর্বত্র।

Follow Us

“শিব ঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছ্‌লে প’ড়ে
প্যায়দা এসে পাক্‌ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
একুশ টাকা দণ্ড তার।।”

এই ছিল সুকুমার রায়ের ‘একুশে আইন’-এ। সেই ‘শিব ঠাকুরের দেশ’ ভারতবর্ষে ১ জুলাই থেকে চালু হয়েছে নতুন আইন। যা সত্যই সব্বনেশে কি না তা নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। এনডিএ সরকারের আমলে দেশের ‘ঔপনিবেশিক’ তিনটি আইনের অবলুপ্তি ঘটেছে। যদিও স্বাধীনতার পর ব্রিটিশদের চালু করা সেই আইনি ব্যবস্থায় বিভিন্ন সময়ে অনেক বদল করা হয়েছিল। তবুও বহুকাল আগে রচিত আইনে ঔপনিবেশিকতার গন্ধ ছিল স্পষ্ট। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনাও হয়েছে বিভিন্ন মহলে। ঔপনিবেশিকতার গন্ধ পুরোপুরি মুছে সময়োপযোগী করতেই নতুন আইনের প্রবর্তন বলে দাবি বর্তমান সরকারের। সেই লক্ষ্যেই ১৮৬০ সালের ইন্ডিয়ান পিনাল কোড (Indian Penal Code, 1860 ) বদলে হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (Bharatiya Nyaya Sanhita বা BNS) ও ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট (Indian Evidence Act,1872) হয়েছে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (Indian Sakshya Act বা ISA), আর ক্রিমিনাল প্রোসিডিওর কোড (Criminal Procedure Code,1898) প্রতিস্থাপিত হয়েছে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (Bharatiya Nagarik Suraksha Sanhita Act বা BNSS) নামে। সমাজে নতুন কিছুর সূত্রপাত হলে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে ঔৎসুক্য তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। নতুন আইন নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। ভারতের মতো বৃহৎ দেশে আইনি ধারার এমন আমূল বদল আগে হয়নি। তাই এই পরিবর্তন নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে সব মহলে। আইনের কারবারি অর্থাৎ বিচারক-আইনজীবীরা নতুন আইনকে নিজেদের মতো করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টায় রত। আইন বলবৎ করার দায়িত্ব যাঁদের অর্থাৎ পুলিশকেও আইনের ধারাগুলি নিয়ে চর্চা শুরু করতে হচ্ছে। এই আইন যাঁদের উপর লাগু হবে অর্থাৎ দেশের জনগণেরও নতুন আইন নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখা প্রয়োজন। পুরনো আইনি ব্যবস্থার সঙ্গে নতুন ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এল, কেন এই পরিবর্তন করা হল, কোন বিষয়গুলি বেশি গুরুত্ব পেল- এ সব নিয়েই টিভি৯ বাংলা ডিজিটালের এই বিশেষ প্রতিবেদন।

নতুন আইনে কোন কোন নতুন বিষয় এল? এই আইন রচনার প্রেক্ষাপটই বা কী? এ সব নিয়ে আলোচনার আগে পুরনো আইন তৈরির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত। তার পর যত সময় গড়িয়েছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিধি ততই বেড়েছে। এত বড় ভূখণ্ড শাসন করতে গেলে আইনের বাঁধন দরকার, ব্রিটিশ শাসকরা ভালোই অনুভব করছিলেন। সেই মতো ভারতের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ শুরু হয়। ১৮৩৪ সালে গঠিত হয় প্রথম ল কমিশন। থমাস বাবিংটন ম্যাকলের নেতৃত্বাধীন সেই কমিশন তৈরি করে আইনি খসড়া। তার পর পেরিয়ে যায় বেশ কিছু বছর। ইতিমধ্যেই সিপাহি বিদ্রোহের আগুনে বেশ টালমাটাল অবস্থা হয় ঔপনিবেশিক শাসকের। এই বিদ্রোহের পরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে ভারতের শাসনভার যায় ব্রিটেনের রানির হাতে। এর তিন বছর পর ১৮৬০ সালে চালু হয় ইন্ডিয়ান পিনাল কোড। পরাধীন দেশের জনগণকে সমঝে রাখা, কোনও রকমের প্রতিবাদ, বিরোধিতাকে দমন করাও উদ্দেশ্যে ছিল সেই আইনের। এর পর যত দিন গিয়েছে বাংলার ‘দামাল ছেলে’ বীর বিপ্লবীদের দমন করতে ওই আইনই ব্রিটিশের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ফাঁসি দেওয়া হোক বা দ্বীপান্তর- বিপ্লবীদের দমনের জন্যে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হত সেই আইন। এমনকি পরাধীন ভারতে বিভিন্ন বই, পত্রিকায় লেখালিখি, বিপ্লবী সংগঠন ভাঙতেও ব্রিটিশের ভরসা ছিল ওই আইন। আসলে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা লড়ছেন, তাঁরা ব্রিটিশের চোখে ‘জঙ্গি’ হিসাবেই পরিগণিত হতেন। এর পর বহু রক্তক্ষয়, বিপ্লবীদের আত্মবলিদানের পর ভারত স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীন ভারতেও বহাল থাকে ব্রিটিশ আমলের পিনাল কোডই।

যদিও স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ান পিনাল কোড (আইপিসি)-এর বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তন করা হয়েছে। তামাদি মানসিকতা ছেড়ে আইনকে যুগপোযোগী করে তোলার একাধিক পদক্ষেপও করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে যেভাবে কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ডের চল ছিল, তার অবলুপ্তি হয়েছে। সমকামিতা, পরকীয়ার মতো বিষয়গুলি নিয়েও আইনের পরিসর বদলেছে। এই পরিমার্জনে দেশের শীর্ষ আদালত সময়ে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সেডিশন বা দেশদ্রোহিতার মতো বিভিন্ন আইন নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বার বার। দেশদ্রোহিতা দমনের নামে, আইনের পরিসরকে ব্যবহার করে, প্রতিবাদী বা সমালোচকদের কণ্ঠরোধের অভিযোগও একাধিকবার উঠেছে সাম্প্রতিক অতীতে। এ রকম পরিস্থিতিতেই অবলুপ্তি ঘটল ব্রিটিশ জমানার আইনের।

নতুন আইনে একই ধরনের বিভিন্ন অপরাধকে এক ছাতার তলায় আনা হয়েছে। এর জেরেই ধারার সংখ্যা কমেছে।

ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের (আইপিসি) পরিবর্তে এসেছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস)। আইপিসি-তে ৫১১টি ধারা ছিল। বিএনএসে ধারা রয়েছে ৩৫৮টি। অর্থাৎ অতীতের থেকে আইনের ধারার সংখ্যা কমেছে। আসলে আগের আইনে একই ধরনের অপরাধের পার্থক্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধারা ছিল। কিন্তু নতুন আইনে একই ধরনের বিভিন্ন অপরাধকে এক ছাতার তলায় আনা হয়েছে। এর জেরেই ধারার সংখ্যা কমেছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চিটিং বা প্রতারণার জন্য একাধিক ধারা ছিল। প্রতারণা বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে। নতুন আইনে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ধারাকে একত্রিত করা হয়েছে। এর জেরে এই সব মামলায় ধারা যোগ অনেক সহজ হবে বলে দাবি আইনপ্রণেতাদের। এর পাশাপাশি ন্যায় সংহিতায় আধুনিক কালে সংগঠিত হওয়া গণপিটুনির মতো বিভিন্ন অপরাধের জন্য আলাদা করে আইন আনা হয়েছে। গত কয়েক বছরে অপরাধের পরিধির বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। অপরাধের ধরন বদলেছে। প্রযুক্তির উন্নতিকে ব্যবহার করে অপরাধের ভয়াবহতা বেড়েছে। সে সব থেকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে নতুন আইনের প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করছেন আইনি কারবারিদের একাংশ। এ বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দেবাশিস কর গুপ্ত বলেছেন, “প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশদের উপনিবেশ হিসাবে ছিল আমাদের দেশ। ব্রিটিশ শাসনকালে আমাদের দেশ ছিল পুলিশ স্টেট। সেখানে তিনটি আইনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত- বহিঃশক্তির আগ্রাসন, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত আইন। ১৯৪৭ সালে আমরা স্বাধীন হলাম। ১৯৫০ সালে পেলাম নতুন সংবিধান। সেখানে আমাদের দেশ জনকল্যাণকারী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পেরিয়েছে। এখন অপরাধের ধরনে শুধু ভারত নয় গোটা পৃথিবীতে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। সেগুলি থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে নতুন আইনের প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে এই বদলকে স্বাগত জানাতে হবে।”

সম্প্রতি বদল হলেও, অতীতে নতুন ধরনের অপরাধ রুখতে, নতুন আইন আনা বা পুরনো আইনের ধারায় প্রয়োজনীয় সংশোধন বা অ্যামেন্ডমেন্ট করা হয়েছে। এবারও কী সে রকম করা যেত না? এই প্রশ্ন তুলছেন খোদ আইনজীবীদের একাংশ। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অর্ক কুমার নাগ এ নিয়ে বলেছেন, “পুরো নতুন একটি ব্যবস্থা আনা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে যে ব্যবস্থা ছিল, পুলিশের হাবিলদার থেকে আইনজীবী- সকলে সেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। সকলকে আবার নতুন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তনে আপত্তি নেই। তবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই। পুরো আইনটা না বদলে দরকার অনুযায়ী আইনের ধারাগুলিকে পরিবর্তন করাও যেতে পারত। অতীতেও তো এ রকম হয়েছে। নতুন কোনও বিষয় নিয়ে নতুন আইন এসেছে। যখন তথ্য প্রযুক্তি আইন এসেছে, ফরেস্ট অ্যাক্ট এসেছে, তখন সে ব্যাপারে নতুন করে আমাদের জানতে হয়েছে। যেমন বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধের তালিকায় আনা হয়েছে নতুন আইনে। বৈবাহিক সম্পর্কে মহিলাদের অতিরিক্ত অধিকার পাইয়ে দেওয়ার জন্য পুরনো আইনে অ্যামেন্ডমেন্ট আনলেই হত। বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। গোটা আইন পরিবর্তনের দরকার ছিল না।”

নতুন এই আইনে বেশ কিছু অপরাধের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান অনেক কড়া হয়েছে। বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনের ধারাগুলিকে আরও জোরদার করা হয়েছে। বৈবাহিক ধর্ষণের মতো একাধিক বিষয় নতুন ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গণধর্ষণের ঘটনায় শাস্তির বিধান বাড়ানো হয়েছে। শ্লীলতাহানির সংজ্ঞার পরিসর বেড়েছে। জিরো এফআইআর-এর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে। ই-এফআইআর নিয়েও স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। আবার সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ নম্বর ধারা অবলুপ্ত হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়। হিট অ্যান্ড রানের মতো ঘটনায় আগে যেখানে অভিযুক্তরা সহজে ছাড়া পেয়ে যেতেন, সেখানে নতুন আইনে এই অপরাধের শাস্তির নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এ রকম একাধিক পরিবর্তন নতুন আইনে এসেছে। অপরাধ আটকাতে আইনের পরিসরকে আঁটোসাটো করার চেষ্টা হয়েছে। সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য। নিয়োগ দুর্নীতি-সহ বর্তমান সমাজে ঘটে চলা একাধিক অপরাধকে সংগঠিত অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। তার মধ্যে ঢুকেছে ডাকাতিও। পুরনো আইনে কোনও অপরাধের ধারায় যে ফাঁকফোকর ছিল, তাও আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে নতুন আইনে। আবার পুরনো আইনের অনেক ধারা একই রয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট আইনের ধারার ক্রমিক সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে। এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দেবাশিস কর গুপ্ত বলেছেন, “১৮৬০ সালের ইন্ডিয়ান পেনাল কোড হল ভারতীয় ন্যায় সংহিতা। পেনাল কোডে ৫১১টি ধারা ছিল। সেখানে কমিয়ে নতুন আইনে রয়েছে ৩৫৮টি ধারা। কিছু অপরাধকে এক জায়গায় আনা হল। যে সব অপরাধ বাদ পড়েছিল, সে দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে। মহিলা ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। নতুন আইনে সেগুলিকে একত্র করা হল। বিশেষ নজর দেওয়া হল।” পুরনো ও নতুন আইনের তুলনা করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “নতুন ধারা সংযোজনের পাশাপাশি অনেক ধারাই কিন্তু পুরনো আইন থেকে তুলে আনা হয়েছে। তাই পুরনো আইন সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া হয়েছে, এ রকম বললে একটু ভুল করা হবে। বরং বলা যায় কিছু পরিমার্জন ও কিছু পরিবর্ধন করা হয়েছে নতুন আইনে।” এ নিয়ে আইনজীবী অর্ক নাগ বলেছেন, “নতুন আইনে অপরাধের সংজ্ঞা নতুন করে লেখা হয়েছে। যেমন শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের মতো ঘটনার সংজ্ঞা আরও বৃহৎ করা হয়েছে। পুরনো অনেক অপরাধকে যুগপোযোগী করে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মহিলাদের অনেক বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে। মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।”

আইনের পরিসর বর্ণনার সময় ভাষার ব্যবহারও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আইনের ভাষায় ব্যবহৃত কোনও পূর্ণচ্ছেদও বিশেষ অর্থবহন করে। তার একটু এদিক ওদিক হলে আইনের মানেও বদলে যায়। এ রকম বেশ কিছু আইনি পরিভাষার বদল আনা হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়। এ নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দেবাশিস কর গুপ্ত বলেছেন, “ভাষার সম্বন্ধে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে নতুন আইনে। মাইনর শব্দটি ব্যবহার না করে চাইল্ড শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইনসেন না বলে পার্সন ইউথ আনসাউন্ড মাইন্ড বলা হয়েছে। আসলে ঔপনিবেশিক আইনে কোনও বিষয়টি যেভাবে ভাষায় বর্ণনা করা হত, সেই বর্ণনার কিছু পরিবর্তন আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিতে করা হয়েছে।” দেশদ্রোহিতা বা জঙ্গি কার্যকলাপের বিষয়গুলি কড়া হাতে মোকাবিলার জন্য নতুন আইনে বড় পরিসর তৈরি করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। যদিও সেডিশনের মতো ঔপনিবেশিক আইনও অবলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু তার বদলে নতুন আইন এসেছে। এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি দেবাশিস কর গুপ্ত বলেছেন, “সেডিশনের ব্যবহারকে সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট অমানবিক বলেছিল। স্বাধীনতার আন্দোলন যাঁরা করতেন তাঁদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে ব্রিটিশরা যে আচরণ করত, স্বাধীন ভারতে তা করা যাবে না বলে আগেই জানিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। সেটি এক্ষেত্রে বদলানো হয়েছে।”

 

আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, নতুন ন্যায় সংহিতায় আইনের প্রয়োগকারী অর্থাৎ পুলিশের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

এত দিন পুরনো আইনেই অপরাধের মামলা হত। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা-সহ মোট তিনটি আইন ১ জুলাই থেকে লাগু হয়েছে। এ মাস থেকে সংগঠিত অপরাধের বিচার হবে নতুন আইনের ধারা অনুযায়ী। কিন্তু বিগত সময়ে যে সমস্ত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তার বিচার কোন আইন অনুযায়ী হবে? এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকেরই মনে। কারণ কোনও অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পর অভিযোগ দায়ের, অপরাধীদের গ্রেফতার, ঘটনার তদন্ত, আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া এবং তার পর বিচার শুরু। গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে অনেকটাই সময় লেগে যায়। আবার বিগত দিনের যে সব লক্ষ লক্ষ মামলা আদালতে বিচারাধীন, সেই সব মামলার বিচার কোন আইন অনুযায়ী হবে, তা নিয়েও রয়েছে জিজ্ঞাস্য। এ বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অর্ক নাগ বলেছেন, “যে সব মামলা ৩০ জুনের আগে দায়ের হয়েছে। সে সব মামলার বিচার পুরনো আইন অনুযায়ীই হবে। নতুন আইনের ব্যাকডেটেড এফেক্ট দেওয়া হয়নি। ২০২৪ সালের ১ জুলাই অনওয়ার্ডস নতুন আইন বলবৎ হয়েছে। ১ জুলাইয়ের পর থেকে দায়ের হওয়া মামলার বিচার হবে নতুন আইনে।” এর জেরে বর্তমানে নতুন মামলার শুনানি যেমন আদালতে চলবে, তেমনই পুরনো মামলার শুনানিও চলবে। অর্থাৎ দুই আইনের ধারা নিয়েই আগামী কয়েক বছর কাজ করতে হবে আইনজীবী, বিচারক, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষকে। এ নিয়ে অর্ক নাগ বলেছেন, “প্রত্যেক জেলায় জেলায় যদি দেখেন লক্ষ লক্ষ মামলা পড়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতির এটা একটা নেতিবাচক দিক। আগামী ১০-১৫ বছর আমাদের পাশাপাশি দুটি আইন নিয়ে কাজ করতে হবে। নতুন আইনের সঙ্গে সড়গড় হতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে।”

এ সবের পাশাপাশি আরও একটি বক্তব্য আইনজীবী মহল তুলছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা নিয়ে। আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, নতুন ন্যায় সংহিতায় আইনের প্রয়োগকারী অর্থাৎ পুলিশের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আইনজীবীদের আশঙ্কা, নতুন আইনে দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। রাষ্ট্র নিজের উদ্দেশ্য সাধনে তাঁর সমালোচক বা প্রতিবাদীকে বিনা বিচারে আটকে রেখে হেনস্থা করতে পারে। এ বিষয়ে অর্ক নাগ বলেছেন, “আমার মনে হয়, আমাদের বিচারব্যবস্থার উপর ভরসা রাখা উচিত। যে কোনও আইন যখন তৈরি হয়, সেই আইনের আক্ষরিক ভাষার বাস্তব প্রকাশ ঘটে, যখন তার বাস্তবিক প্রয়োগ এবং জুজিসিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন হয়। তদন্ত না করে অভিযুক্তকে পুলিশি হেফাজতে ৯০ দিন আটকে রাখা যেতে পারে। কিন্তু এই কথাটি আদালত মানবে কি না, আদেও তা আদালতে ধোপে টিকবে কি না, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখনই তা নিয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি। আদালত বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” আইনের প্রয়োগকারীরা বেশি ক্ষমতা পেলেও খুব সহজে আইনের অপব্যবহার করতে পারবেন না বলেই বিশ্বাস অর্কবাবুর। এ ব্যাপারে দেশের বিচারব্যবস্থার উপর ভরসা রাখার পক্ষে তিনি। এ বিষয়ে বলেছেন, “যদি কোনও ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে, অগণতান্ত্রিকভাবে আটকে রাখা হয়, তাকে আটকানোর যথেষ্ট পরিসর আমাদের আইনে এখনও আছে। এখনও আমাদের সংবিধান অনেক শক্ত। মাথার উপর সাংবিধানিক আদালতও রয়েছে। এ রকম ঘটলে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারবে। আমার মনে হয়, এ নিয়ে এখনই খুব ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তবে আইনের প্রয়োগকারী পুলিশের হাতে অনেকটা ক্ষমতা দিয়েছে নতুন আইন। এই ক্ষমতা খর্ব করতে অনেক মানুষকে বার বার আদালতে ছুটে আসতে হতে পারে।” অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিও দেবাশিস কর গুপ্তও মনে করেন, নতুন আইনে সংবিধান বিরোধী কোনও ক্ষেত্র থাকলে সাংবিধানিক আদালত তা নিশ্চিতভাবে পরিমার্জন করবে।

আইপিসি-র পরিবর্ত হিসাবে বিএনএস এসেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের আইনব্যবস্থায় নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে। নাগরিক সুরক্ষা দিতে অপরাধীরা যাতে আরও বেশি শাস্তি পায়, সে পরিসর তৈরি করা হয়েছে। তবে এই উদ্দেশ্য তখনই সাধিত হবে, যদি সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়। তা করার কাজ যেমন পুলিশের। সেই কাজের নজরদারির দায়িত্ব বিচারবিভাগের। মাত্র কয়েক দিন এই আইন লাগু হয়েছে। এর ভালো-খারাপ বিচার করা বা সমালোচনার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা দরকার। আইনজীবী থেকে বিচারপতি- এ ব্যাপারে সকলেই একমত।

Next Article