নয়াদিল্লি: ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে দেলারু দুর্নীতি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে মোদী সরকারের। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্রিটিশ সংস্থা দেলারু কর্পোরেশনের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। চুক্তি অনুযায়ী, দেলারু ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নোট ছাপার বিশেষ সিকিউরিটি পেপার সরবরাহ করবে এবং কেবল মাত্র ভারতের জন্য তৈরি বিশেষ কালার শিফ্টিং সিকিউরিটি থ্রেড সরবরাহ করবে। এই চুক্তি যখন হয়েছিল তখন দেশের অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন পি চিদাম্বরম। অভিযোগ, যে সমস্ত ব্যাপারে দেলারু আরবিআই-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তা পূরণ করেনি। এমনকি সরবরাহ করা সিকিউরিটি পেপারের মান নিয়েও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে ওই সংস্থার অন্দরে।
ব্রিটিশ সংস্থা দেলারু বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা। যারা ব্যাঙ্ক নোট ছাপার বিশেষ সিরিউরিটি পেপার এবং ব্যাঙ্ক নোটের সিকিউরিটি ডিজাইন সরবরাহ করে। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে ওই ব্রিটিশ সংস্থা এই কাজ করছে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশের ব্যাঙ্ক নোট সংক্রান্ত নিরাপত্তা প্রযুক্তি দেয় দেলারু।
পি চিদাম্বরমের পর প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব নেন। ২০১০ সালে প্রকাশ্যে আসে দেলারু যে সিকিউরিটি পেপার ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সরবরাহ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল তা করেনি। দেলারু সংস্থার অন্দর থেকেই ফাঁস হয় সিকিউরিটি পেপারের মান নিয়ে জালিয়াতি করেছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরই প্রণব মুখোপাধ্যায় গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ব্ল্যাক লিস্টেড করার নির্দেশ দেন দেলারু সংস্থাকে। কিন্তু তার পরও ২০১৫ সাল পর্যন্ত বার বার দেলারু-র সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বেড়েছে। অভিযোগ, জাতীয় নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে বেআইনি ভাবে দেলারু সংস্থার সঙ্গে বার বার চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছিল ইউপিএ সরকার।
২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি দেলারু সংস্থা এবং ইউপিএ জমানার অর্থসচিব অরবিন্দ মায়ারামের বিরুদ্ধে এফআইএর করে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। এফআইআর করার পরদিনই মায়ারামের দিল্লি এবং জয়পুরের বাড়িতে তল্লাশি চালান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
• ২০০৪ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ কালার শিফ্টিং সিকিউরিটি থ্রেড সরবরাহ করার চুক্তি হয় দেলারু-র।
• তদন্তে জানা গিয়েছে, চুক্তি যখন হয়েছিল সেই সময় ওই সিকিউরিটি থ্রেডের জন্য প্রয়োজনীয় পেটেন্ট আদৌ ছিল না দেলারু সংস্থার।
• সেই পেটেন্ট তারা পায় ২০১১ সালে।
• ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড মিন্টিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড বিষয়টি মায়ারামকে জানালেও তিনি কর্ণপাত করেননি এবং ২০০৯ সালে দেলারু সংস্থার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয় বেআইনি ভাবে।
• সিবিআইয়ের দাবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া দেলারু-র চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
• সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে দেলারু সংস্থার হয়ে যে অনিল রঘুবীর চুক্তি করেছিলেন, ২০১১ সালে তাঁর অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন অজ্ঞাত সংস্থা থেকে ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা জমা পড়েছিল যেটা তাঁর বেতনের বাইরে।
সূত্রের খবর, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পর ফের অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন চিদাম্বরম। সেই সময় দেলারু-র বিরুদ্ধে জারি করা ব্ল্যাক লিস্ট তকমা সরাতে তৎপর ছিল অর্থমন্ত্রক। সূত্রের খবর, দেলারু যে মানের সিকিউরিটি পেপার এবং সিকিউরিটি থ্রেডের প্রযুক্তি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সরবরাহ করেছিল, সেই একই মানের কাগজ এবং প্রযুক্তি সরবারহ করেছিল পাকিস্তানকে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, পাকিস্তান জাল ভারতীয় নোটের মূল উৎসস্থল। সেখান থেকেই জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট ছাপার প্রযু্ক্তির মধ্যেই কি লুকিয়ে ছিল জাল নোটের ভূত? আর সেই সর্ষের মধ্যে থাকা ভূতকে নিকেশ করতেই কি নোটবন্দির সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের?
ইউপিএ জমানায় নোট ছাপার জন্য পৃথক সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড মিন্টিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া তৈরি হয়। তার প্রথম চেয়ারম্যান অশোক চাওলা এবং প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর মায়ারাম। চিদাম্বরম ঘনিষ্ট অশোক চাওলার নাম রয়েছে এয়ারটেল-ম্যাক্সিম কেলেঙ্কারির চার্জশিটে। এই ধরণের পদ তৈরি করে নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাপন্টমেন্ট কমিটি অফ ক্যাবিনেটের অনুমতি লাগে। সেই অনুমতি ছাড়াই কী ভাবে নিয়োগ অশোক চাওলা এবং মায়ারামের? সূ্ত্রের খবর, সিবিআই তদন্ত যে দিকে চলছে তাতে লোকসভা নির্বাচনের আগে, চিদাম্বরম-সহ ওই জমানার একাধিক নেতা এবং প্রাক্তণ আমলারা বেকায়দায় পড়বেন। যেহেতু গোটা বিষয়টির সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত তাই এই কেলেঙ্কারি বড় হাতিয়ার হতে চলেছে মোদীর।