
অম্বানি পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে কেটে গিয়েছে বেশ কয়েক মাস। রাধিকা মার্চেন্ট ও অনন্ত অম্বানির বিয়ে। ২০২৪ সালের এই বিয়ে কেবল সাধারণ বিয়ে ছিল না।
সামাজিক অনুষ্ঠানের বাইরে গিয়েও এই বিয়ে চোখ টেনেছিল গোটা দেশ তথা বিশ্বের। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে এই বিয়ে ভারতের সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার এমন এক মঞ্চ হয়ে উঠেছিল, যা ভারতকে বিশ্বের মানচিত্রে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মূলধারার গণমাধ্যম তো বটেই সামাজিক মাধ্যমেও কোটি কোটি মানুষের চোখ ছিল অম্বানিদের ছোট ছেলের বিয়েতে। কী ভাবে অনন্য এই বিয়ে?
হিন্দু বিয়ের পবিত্রতা
হিন্দু সংস্কৃতিতে বিয়ে কেবল একটি সামাজিক বন্ধন নয়, এটি এক পবিত্র প্রতিশ্রুতি। বিয়ে মানে শুধু দুটি ব্যক্তির মিলন নয়। তাঁদের পরিবার, সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় কর্তব্য পালনের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষার আজীবন প্রতিশ্রুতি। আজকাল অনেকেই আধুনিকতার নামে নানা বিয়ের রীতি এড়িয়ে চলেন। কিন্তু অনন্ত ও রাধিকা তা করেননি। ভারতীয় সংস্কারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকেই পালন করেন প্রতিটি প্রথা। বয়োজ্যেষ্ঠ এবং আধ্যাত্মিক গুরুদের আশীর্বাদ নিয়েই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন যুগলে। উপস্থিত ছিলেন সাধুসন্ত থেকে বলিডউ তারকা, ওয়ার্ল্ড বিজনেজ লিডাররাও।
ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি দৃঢ় হওয়া
একদিকে ভারত আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও শিল্পক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতা হয়ে উঠছে। সেই একই সময়ে এই আয়োজন ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী রূপে পরিচিতিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। বিশিষ্ট অতিথিদের উপস্থিতি ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাব, অর্থনৈতিক শক্তি, কূটনৈতিক অবস্থান এবং বিজ্ঞান-মনস্ক পরিচিতির প্রমাণ। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও অম্বানি পরিবার এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ব নেতৃত্বের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, এবং ভারতের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করেছে বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের।
মানবিকতা ও সংস্কারের সম্মিলন
‘মানব সেবাই মাধব সেবা’ – এই আদর্শ মেনেই বিয়ের সূচনা হয় ৫০ জন দম্পতির গণ বিবাহদানের মাধ্যমে। রিলায়েন্স কর্পোরেট পার্ক, নাভি মুম্বাই-এ আয়োজন করা হয় সেই অনুষ্ঠানের। অম্বানি পরিবারের প্রতিটি সদস্য সেদিন উপস্থিত ছিলেন। নবদম্পতিদের আশীর্বাদ ও উপহারও দেন।
এছাড়াও বিয়ে চলাকালীন তিন সপ্তাহব্যাপী চলে ভাণ্ডারা বা কমিউনিটি কিচেন। যেখানে প্রতিদিন ১,০০০ বেশি মানুষের জন্য দুপুর ও রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়।
বিয়ের রীতি ও অনুষ্ঠান –
একাধিক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতি পালন করেই হয় বিয়ে। পালন করা হয় –
মোসালু – প্রাচীন এই গুজরাটি প্রথা অনুসারে বরের মামা কনে ও বরকে ঐতিহ্যবাহী উপহার প্রদান করে। যা মামেরু নামে পরিচিত।
ভ্যালি অফ গডস – জামনগরে মন্দিরে আধ্যাত্মিকতা ও ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং কনে-বরের প্রতি ভালবাসা জানাতে নীতা অম্বানির নেতৃত্বে আয়োজন করা হয় নৃত্যানুষ্ঠানের।
সঙ্গীত – গানের ও নাচের মাধ্যমে আনন্দোৎসব আজ ভারতীয় বিয়েতে খুবই সাধারণ। এই দিন সঙ্গীতে পারফর্ম করেন মুকেশ ও নীতা অম্বানিও।
গ্রহ শান্তি – নবদম্পতির সুখ-সমৃদ্ধি এবং নেতিবাচকতাকে দূরে রাখতে আয়োজন করা হয় নবগ্রহ ও গণেশ পুজোর।
পীঠি বা হলদি – এটা সাধারণ ভাবে গায়ে হলুদ নামে পরিচিত।
ভজন ও শিব-শক্তি পূজা – দেবী-দেবতার মিলন এবং সংসারের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রতীক হিসাবে আয়োজন করা হয় এই পুজোর।
মূল বিবাহ অনুষ্ঠান – অগ্নিসাক্ষী করে বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতিতে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ ও সব রীতি মেনে সম্পন্ন হয় মূল বিয়ের অনুষ্ঠান।
রিসেপশন – তিন দিন ধরে চলা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বন্ধু, আত্মীয়, সহকর্মী, এবং গৃহকর্মচারীদের সম্মানিত করে অম্বানি পরিবার।
বিয়ের থিম –
বেনারসের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভারতীয় পোশাকের জৌলুস ছিল বিয়ের মূল থিম। যার পোশাকি নাম ‘বেনারসের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’। জিও ওয়ার্ল্ড সেন্টারে এই থিমে বারাণসীর ঘাট, গলি, সংস্কৃতি, শিল্প, ও খাদ্যাভ্যাসকে পুনর্নির্মাণ করে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি করে। যা দেখে মনে হচ্ছিল সত্যি বেনারসে আছেন সকলে।
‘Resplendently Indian’বা ‘উজ্জ্বল ভারতীয়’ এই ছিল বিয়ের পোশাকের থিম। এই থিমে সাজানো পোশাকের মাধ্যমে অতিথিরা ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। নিপুণ কারিগরি এবং ঐতিহ্যের সমাহারে বিশ্ব দরবারে ফুটে ওঠে ভারতের শৈল্পিক ঐশ্বর্য।
মোট কথা রাধিকা মার্চেন্ট ও অনন্ত অম্বানির বিয়ে কেবল দুটি মানুষের মিলন অনুষ্ঠান ছিল না। ভারতীয় ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিকতা এবং বৈশ্বিক সম্প্রীতির এক বিস্ময়কর সংমিশ্রণ। এই অনুষ্ঠান ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। যা বিশ্বকে আবার মনে করিয়ে দেয়—ভারত শুধু প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতেই নয়, আধ্যাত্মিকতাতেও বিশ্বনেতা।