নয়া দিল্লি: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া সফরের হাত ধরে ভারত-রাশিয়া প্রতিরক্ষা সম্পর্কের ধাঁচটাই বদলে যেতে চলেছে। মোদীর সফর শেষ হতে না হতেই ভারতকে একের পর এক চমকে দেওয়া প্রস্তাব পাঠাচ্ছে রাশিয়া। যৌথভাবে ট্যাঙ্ক, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গোলার তৈরির পাশাপাশি যুদ্ধবিমান নিয়ে বড় প্রস্তাব দিল পুতিনের দেশ। রুশ বায়ুসেনার অন্যতম সেরা অস্ত্র “সুখোই ৭৫ চেকমেট”। রাশিয়ার এই স্টিলথ এয়ারক্রাফট একদিকে বিধ্বংসী। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় আকাশে থেকে অপারেশনের উপযোগী। রাশিয়ার বক্তব্য, ভারতীয় বায়ুসেনায় মিগ-টোয়েন্টি নাইনের পরিবর্তে সুখোই সেভেনট্টি ফাইভ-ই সেরা বিকল্প।
২০২১ সালে ‘সুখোই ৭৫ চেকমেট’ রুশ বায়ুসেনায় অন্তর্ভূক্ত হয়। সিঙ্গল ইঞ্জিন, লাইটওয়েট ক্যাটেগরির সুখোই ৭৫ চেকমেন্ট নিজের ফিল্ডে দুনিয়ার সেরা যুদ্ধবিমান বলেও দাবি রাশিয়ার। রুশ বায়ুসেনার এক আধিকারিক সংবাদসংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, “রাশিয়া, ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে ভারতেই সুখোই ৭৫ তৈরিতে আগ্রহী। ভারত ২০০টির বেশি বিমানের অর্ডার দিলে ভারতে ফ্যাক্টরি তৈরি করে বিমান তৈরি করবে রুশ সংস্থাগুলো”। সেক্ষেত্রে আগামী ৪ বছরে ২০০টির বেশি বিমান ভারতীয় সেনার হাতে আসবে।
আগামী ৭ থেকে ১০ বছর পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির প্রকল্পে হাত দিয়েছে ভারত। এজন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি বরাদ্দও হয়েছে। এই বাজারটা ধরতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই ঝাঁপাচ্ছে রুশ সংস্থাগুলো। তাই আগেভাগেই ভারতকে বার্তা দিয়ে রাখছে তাঁরা। ভারত কী সেক্ষেত্রে একক ভাবে বিমান তৈরির চেষ্টা ছেড়ে রাশিয়ার হাত ধরবে? প্রতিরক্ষামন্ত্রকের এক কর্তা জানিয়েছেন, প্রশ্নই ওঠে না। ভারত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজস্ব পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করবে। এক্ষেত্রে অন্য কারও হাত ধরার প্রশ্ন নেই। তাঁর বক্তব্য, “আমরা তো বহু যুগ ধরে মিগ সিরিজের বিমান ব্যবহার করছি। সুখোই এমকে ওয়ানের মতো যুদ্ধবিমানও তৈরি করেছি। সেনা সুখোই ৭৫-র দাবি করলে সেটাও খতিয়ে দেখা হবে। তবে পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই।”
অন্য কোনও দেশের সঙ্গে যৌথভাবে নয়, ১০০ শতাংশ ভারতীয় প্রযুক্তিতে ভারতেই তৈরি হবে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। ২০২৪-র মার্চে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ১৫ হাজার কোটি টাকা প্রকল্পে অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতের হাতে আসবে দেশীয় প্রযুক্তির প্রথম স্টেলথ যুদ্ধবিমান। নতুন প্রজন্মের এই যুদ্ধবিমান তৈরির পুরো দায়িত্বে ‘ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ বা ডিআরডিও। যুদ্ধবিমানটি তৈরি করবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল। কেমন হবে ভারতের নিজস্ব স্টেলথ যুদ্ধবিমান। প্রকল্পের ডিরেক্টর, রাজেন্দ্র নীলির দাবি, ভারতের স্টেলথ দুনিয়ার উন্নত যুদ্ধবিমানের সঙ্গে যুদ্ধবিমানের সঙ্গে টেক্কা দেবে। এতে এমন প্রযুক্তি থাকবে, তা দুনিয়ার যে কোনও দেশের রেডারকে এড়িয়ে হামলা চালাতে পারবে। আমরা এমন বিমান তৈরি করব, যা অন্তত ২ ডজন অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে পারবে।
ডিআরডিও সূত্রে খবর, প্রাথমিকভাবে পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরি হতে পাঁচ বছর লাগবে। তারপর আরও পাঁচ বছর ধরে সেটিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলার কাজ হবে। যতদিন সেটা না হচ্ছে, ততদিন আপগ্রেডেড সুখোই-ই সেনার ভরসা। ২০২৪-র ফেব্রুয়ারিতে বায়ুসেনার হাতে থাকা সুখোই যুদ্ধবিমানগুলির আধুনিকীকরণের কাজ শুরু হয়েছে। সুখোইয়ের সঙ্গে জুড়ছে ব্রহ্মস।
২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সুখোই এমকে- ৩০ থেকে ছোঁড়া ব্রহ্মসের অত্যাধুনিক ভার্সন নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত করে। তখনই বোঝা গিয়েছিল এই জুটি অসাধ্যসাধনের ক্ষমতা রাখে। তাই এবার এই জুটি ঘিরেও আরও বড় ভাবনা প্রতিরক্ষামন্ত্রকের। সূত্রের খবর, দেশের ৬ বায়ুসেনা ঘাঁটিতে সুখোইকে ব্রহ্মস রেডি করে তোলার কাজ শুরু হচ্ছে। আগামী সাড়ে তিন বছরে সেই কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control) ও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Actual Control)-র পাশাপাশি ভারত মহাসাগরে ভারতীয় জলসীমার সুরক্ষায় রয়েছে সুখোই এমকে – ৩০। সেনাকর্তাদের বক্তব্য, জলসীমা ও স্থলসীমায় একই রকম কার্যকর সুখোই ও ব্রহ্মসের জুটি। ব্রহ্মসের রেঞ্জ ৪০০ কিমি। অন্যদিকে, সুখোই থেকে ভারত মহাসাগরের অনেকটা ভিতরে আঘাত করতে পারে ব্রহ্মস।
সুখোই থেকে ছোঁড়া ব্রহ্মসের সাফল্যের হার ৯৩ শতাংশ।
সুখোই-৩০এমকেআই এই মুহূর্তে ভারতের হাতে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমানগুলির অন্যতম। ব্রহ্মস শুধু ভারতের নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছিল। শব্দের গতির প্রায় তিন গুণ বেগে এই ক্ষেপণাস্ত্র ধেয়ে যায় লক্ষ্যের দিকে। প্রথাগত বিস্ফোরক বা পরমাণু অস্ত্র নিয়ে আঘাত হানতে বহু দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত আঘাত হানতে পারে। ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত প্রধান আরকেএস ভাদোরিয়ার বক্তব্য, ব্রহ্মস রেডি সুখোই ডেডলি কম্বিনেশন। আড়াই টন ওজনের ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ও সুখোই এমকে-৩০ যে কোনও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনা কর্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় বায়ুসেনা এ বার যুদ্ধবিমানের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকা লক্ষ্যবস্তুকেও ব্রহ্মস ছুড়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। যে সব লক্ষ্যবস্তু অত্যন্ত শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে, সেখানেও ব্রহ্মস হামলা চালাতে পারবে সুখোই।