
নয়া দিল্লি: রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জি২০ নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নাম বিতর্ক। ইংজিতে সাধারণত ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’ বলে উল্লেখ করা হলেও, এই আমন্ত্রণপত্রে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তাঁর মন্ত্রিসভার সতীর্থদের এই বিতর্কে প্রবেশ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু, চায়ের দোকান থেকে টিভি চ্যানেলের প্যানেলে আলোচনা হচ্ছে এই বিষয় নিয়েই। সংবিধানে স্পষ্টভাবে ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দুটি নামই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু, বিজেপি শিবিরের নেতারা ইন্ডিয়া নামটি বাদ দেওয়াক দাবি তুলছেন। তাঁদের মতে, এই নামের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অতীত জড়িয়ে রয়েছে। অন্যদিকে, বিরোধী দলগুলির দাবি, এই নাম বিতর্ক তুলে আসল দেশের সমস্যাগুলি থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে চাইছে সরকার। মজার বিষয় হল, আমাদের দেশের নাম এই দুটি নয়। বরং কালে কালে দেশের নাম বারবার বদলেছে। মেলুহা, হিন্দ, আর্যাবর্ত – নামের অভাব নেই। নাম বিতর্কের এই অবসরে, আসুন জেনে নেওয়া যাক, ভারতের কী কী নাম রয়েছে? কীই বা এই নামগুলির ইতিহাস?
মেলুহা
প্রায় ৪৫০০ বছর আগের কথা। ব্রোঞ্জ যুগে সুমেরীয় সভ্যতার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়িক অংশীদার ছিল মেলুহা। সুমেরীয় সভ্যতার বিভিন্ন লেখতে মেলুহা থেকে জাহাজ আসার উল্লেখ রয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, মেলুহা বলতে সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে ওঠা সভ্যতা, অর্থাৎ, আমাদের দেশের কথাই বলা হয়েছে।
হিন্দ বা হিন্দুস্তান
২৫০০ বছর আগে ইরান-মিশরের সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতার। পারস্য ভাষায় ‘স’-এর উচ্চারণ ছিল ‘হ’-এর মতো। তাই সিন্ধু উচ্চারণ ভুলে হয়ে গিয়েছিল হিন্দু। পারস্য সভ্যতার মানুষ, এই সভ্যতাকে বলত আল-হিন্দ। পরবর্তীকালে এই এলাকা হিন্দু-হিন্দ-হিন্দুস্থান নামে পরিচিতি লাভ করে।
ইন্ডিয়া
হিন্দুস্তান বা হিন্দ শব্দই পরবর্তীকালে অপভ্রংশে ইন্ডিয়া হয়ে যায়। বর্তমানে অনেকেই ইন্ডিয়া নামটি ব্রিটিশদের দেওয়া বলে দাবি করলেও, ইন্ডিয়া শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ২৩০০ বছর আগে, গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বর্ণনায়। পরবর্তীকালে, ব্রিটিশরাও ভারতে এসে সিন্ধু উপত্যকাকে উচ্চারণের সুবিধার জন্য ভারত বা হিন্দুস্তানের পরিবর্তে ইন্ডিয়া শব্দটি ব্যবহার শুরু করেছিল।
জম্বুদ্বীপ
২২০০ বছর আগে, সম্রাট অশোকের সময়, আমাদের দেশ জম্বুদ্বীপ নামেও পরিচিত ছিল। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, সেই সময় ভারতে প্রচুর জামগাছ ছিল। তা থেকেই এই নামটির উদ্ভব হয়েছিল। আবার, এর পিছনে একটি লোককথাও রয়েছে। কথিত আছে, অতীতে জম্বু নামে এক গাছ ছিল, যাতে হাতির মতো বিশাল আকারের ফল ধরত। সেই ফল পাহাড়ে পড়ে তাদের রস থেকেই নদীর সৃষ্টি হয়েছে। এই নদীর তীরে অবস্থিত ভূমি বলে নাম হয়েছিল জম্বুদ্বীপ।
ভারতবর্ষ বা ভারতখণ্ড বা ভারত
আমাদের দেশের সর্বকালের সবথেকে জনপ্রিয় নাম হল ভারতবর্ষ বা ভারতখণ্ড বা ভারত। এই নামটি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে বলে দাবি করা হলেও, ২১০০ বছর আগে কলিঙ্গ রাজ্যের জৈন রাজা খারবেলাই প্রথম এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে করেন একাংশের ইতিহাসবিদ। পুরাণেও অবশ্য হিমালয়ের দক্ষিণাংশের ভূমিকে ভারত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নামকরণের পিছনে বেশ কয়েকটি কাহিনি রয়েছে। সবথেকে জনপ্রিয় হল, মহারাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র, ভরতের নামানুসারেই ভারত নামটির উদ্ভব। আবার অনেকে মনে করেন, গুরু ঋষভদেব বনবাসে যাওয়ার আগে, তাঁর রাজ্য তাঁর পুত্র ভরতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর নামানুসারেই দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ। দশরথের পুত্র তথা রামের ভাই ভরত কিংবা নাট্যশাস্ত্রের রচয়িতা ভরতমুনির নাম থেকেও এই নামকরণ হয়েছে বলে কথিত আছে।
আর্যাবর্ত বা আর্যদেশ
মনে করা হয়, বহু প্রাচীনকালে আর্যরা আমাদের দেশে এসে বসবাস শুরু করেছিল। আর্যদের ভূখণ্ড হিসেবে, এর নাম হয় আর্যাবর্ত। আর্যাবর্তের সীমানা ছিল কাবুলের কুম্ভা নদী থেকে ভারতের গঙ্গা নদী এবং কাশ্মীর উপত্যকা থেকে নর্মদা নদী পর্যন্ত। তবে, আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ২০০০ বছর আগে রচিত, ধর্মশাস্ত্রে আর্যাবর্ত বা আর্যদেশ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে, এই নামগুলির সবকটিই মূলত উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিকে বোঝায়। দক্ষিণ ভারত, অর্থাৎ, বিন্ধ পর্বতের দক্ষিণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পা পড়েনি বিদেশি পর্যটকদের। ফলে, তাদের দেওয়া নামগুলি সবই উত্তর ভারত সম্পর্কিত। মনুস্মৃতিতে বিন্ধ পর্বতের উত্তরের অংশকে আর্যাবর্ত এবং দক্ষিণের অংশকে দ্রাবিড় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।