
কথায় বলে ‘রাখে হরি মারে কে’। এও যেন ঠিক তাই। নানা কারণে এই দিন ৪১ জন পর্যটক পৌঁছতেই পারেনি বৈসরন ভ্যালিতে। ঠিক তেমনই যেন এক ‘দৈব যোগ’ বাঁচিয়ে দিল একই পরিবারের ১১ জন সদস্যের প্রাণ। পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। ১৯ তারিখ কাশ্মীর পৌঁছে, গুলমার্গ, সোনমার্গ ঘুরে ২২ তারিখ জঙ্গি হামলার সময় তাঁরাও পহেলগাঁওতেই। বৈসরন ভ্যালিতে উঠব উঠব করছেন। তাঁর আগে দুপুরের পেটপুজোটা সেরে নিতে চেয়েছিলেন কেরালার এই পরিবার।
সেই মতোই একটি রেস্তোরাঁয় খেতে ঢোকেন তাঁরা। কাশ্মীর গেলেন আর সেখানকার সিগনেচার ডিশ না খেলে হয়? তাই মটন রোগানজোশ অর্ডার করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেই মটন রোগানজোশ সার্ভ হতেই বাঁধল গোল। আসলে অসম্ভব নুন বেশি ছিল সেই রান্নায়। সেই নিয়েই দোকান মালিকের সঙ্গে বাঁধে বচসা। ঝামেলা করতে গিয়েই দেরি হয়ে গিয়েছিল সেই দিন। তখন মাথা গরম হলেও, সেই নুন বেশি হওয়াই সাপে বর হয়েছিল গোটা পরিবারের জন্য। কারণ নোনতা রোগানজোশ দিয়ে গোল না বাধলে হয়তো ততক্ষণে বৈসরন ভ্যালিতে পৌঁছে জঙ্গিদের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারাতেন তাঁরাও।
ইংরেজি সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে একটি সাক্ষাতকারে ওই পরিবারের এক সদস্য লাবণ্য বলেন, “মঙ্গলবার শ্রীনগর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে পহেলগাঁও যাচ্ছিলাম আমরা। আগের দিন হেকটিক শিডউলের কারণে দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই আমার স্বামী দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিতে জোড় করেন। জায়গাটা পহেলগাঁওয়ে, ১৫ মিনিট দূরে।”
রাস্তার ধারে একটি ধাবায় তাঁরা খাওয়া সারবেন বলে ঠিক করেন। সেই মতোই রোগানজোশ অর্ডার দেন। কিন্তু প্রথমবারের রান্না অত্যন্ত নোনতা হওয়ায় রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ ফের একবার নতুন করে তা রান্না করে দেন। সেই কারণেই প্রায় এক ঘন্টারও বেশি দেরি হয়েছিল তাঁদের।
ফের যাত্রা শুরু করার পরে বৈসরন থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখতে পান তাঁরা। লাবণ্য বলেন, “ঘোড়া-গাড়ি, পর্যটকরা সকলে দৌড়ে নীচে নেমে আসছিল। কিন্তু স্থানীয় ভাষার কিছুই আমরা বুঝতে পারছিলাম না।”
সন্দেহ হলে তাঁরা জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, উপরে কিছু একটা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষীরা ওই দিকে গেছে। যদিও তাঁদের গাড়ির চালক জানান, এই রকম জিনিস এখানে খুবই সাধারণ বিষয়, চিন্তার কোনও কারণ নেই। বৈসরন ভ্যালি যাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যার কথা বুঝতে পেরে তাঁরাই আর উপরে যেতে চাননি। যদিও তখনও জঙ্গি হামলার কথা জানতেন না তাঁরা।
লেকের ধারে ভ্যালিতে সময় কাটাচ্ছিলেন তাঁরা। এরপরে প্রায় সাড়ে ৪টে নাগাদ এক স্থানীয় দোকানদার এসে তাঁদের বলেন, কিছু বড় সমস্যা হয়েছে আপনারা ফিরে যান। রিসর্টে ফেরার পথেই পর পর ফোন আসতে থাকে, তখনই জঙ্গি হামলার কথা জানতে পারেন তাঁরা।
একই ভাবে মহারাষ্ট্র থেকে আসা ২৮ জনের এক পর্যটকের দলেরও বৈসরন ভ্যালি যাওয়া হয়নি একসঙ্গে অতগুলো ঘোড়া না পাওয়ার কারণে। না হলে সেদিন হয়তো প্রাণ হারাতে হত তাঁদেরও।
ভেলপুরীর খিদে প্রাণ বাঁচিয়ে দেয় মিহির আর কোমল সোনির। বৈসরনে পৌঁছে ভেলপুরী কিনে এক কোণে বসে খাচ্ছিলেন তাঁরা। সেই সময় হঠাৎ গুলির শব্দ শুনতে পান। তাঁরা দেখেন ঠিক তাঁদের আগে ওই একই ভেলপুরী বিক্রেতার থেকে ভেলপুরী নিয়ে যাওয়া নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে তাঁর স্ত্রীর সামনে গুলি করে হত্যা করে জঙ্গিরা। কোমলরা জানান, বৈসরনের বাইরের যাওয়ার জায়গা থেকে ১০ পা দূরে ছিলেন তাঁরা। তাই কোনও রকমে সেখান থেকে বেরিয়ে ৪০০০টাকা দিয়ে একটা টাট্টু ভাড়া করে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন যুগলে। আসলে ভাগ্যই যে মঙ্গলবার বাঁচিয়ে দিয়েছিল ৪১ জনকে তা মেনে নিচ্ছেন নিজেরাও।