বুকে ভয়, চোখে মুখে একরাশ আতঙ্ক। ত্রাণ শিবিরে রাত কাটলেও, দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি। বুকে জমাট বাঁধছিল ‘দানা’র ভয়। ওড়িশার ধামরা ও ভিতরণকণিকার মাঝে আছড়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় দানা। বর্তমানে ধীরে ধীরে শক্তি খোয়ালেও, ল্যান্ডফলের সময় ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বইছিল। এই ঝড়ের সামনে কাঁচা বাড়ি কেন, পাকা বাড়িও টেকা দায়। কিন্তু শুক্রবার সকালে দেখা গেল, যতটা ভয় ধরিয়েছিল দানা, ততটা প্রভাব ফেলেনি। এমন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়, প্রকৃতির রোষ থেকে কে রক্ষা করল ভিতরকণিকাকে? প্রকৃতিই। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
ছোটবেলায় ভূগোলের বইয়ে উল্লেখ ছিল ম্যানগ্রোভ অরণ্যের। কীভাবে প্রাকৃতিক বাঁধের কাজ করে এই গাছ। একইসঙ্গে কীভাবে জল ও জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রকেও বাঁচিয়ে রাখে। এরই বাস্তব উদাহরণ ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাব। ওড়িশার মন্ত্রী সূর্যবংশী সূরজ জানিয়েছেন, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্যই জনবসতিতে বিশেষ একটা প্রভাব পড়েনি ঘূর্ণিঝড়ের।
ভিতরকণিকা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ঠিক যেখানে ল্যান্ডফল হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের, সেখানে মানুষের বসবাস নেই। রয়েছে বিরাট ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ঝড়ের দাপট পুরোটাই সহ্য করেছে এই অরণ্য। জঙ্গলের কারণেই ঝড়ের গতি জনবসতিতে পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা কমে গিয়েছে।
একই ছবি ধামরাও। ধামরার উল্টোদিকের ৯টি দ্বীপ মূলত ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ভরা। ঘূর্ণিঝড় ল্যান্ডফলের পর উপকূলবর্তী এলাকায় ব্য়াপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হলেও, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কারণেই সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়নি।
শুধু তো ওড়িশা নয়, বাংলাকেও বারেবারে ঘূর্ণিঝড়ের দাপট থেকে বাঁচিয়ে আসছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যই। ২০১৯ সালে যখন বাংলার উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, তখন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ছিল সুন্দরবন থেকে শুরু করে কলকাতা সহ দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের। কিন্তু ঝড়ের দাপট পুরোটাই বুক পেতে সহ্য করেছিল সুন্দরবন, যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য রয়েছে। বুলবুলে কমপক্ষে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু তারপরও পরিবেশবিদরা বারবার বলেছেন যে বুলবুলের প্রভাব আরও ভয়ঙ্কর হতে পারত। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্যই তা থেকে রক্ষা মিলেছে। বুলবুলের আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আয়লার প্রভাব থেকেও এভাবেই কলকাতাকে রক্ষা করেছিল ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
ঘূর্ণিঝড় যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপকূলের পথ ধরে স্থলভাগে প্রবেশ করে, তখন ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার, এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১৫০ কিলোমিটার অবধিও ঝড়ের গতিবেগ হতে পারে। কিন্তু উপকূলবর্তী এলাকায় ম্যানগ্রোভ অরণ্য থাকলে, ঘন গাছের মাঝে আটকা পড়ে ঝড়ের গতিবেগ অনেকটাই কমে যায়। ম্যানগ্রোভের শিকড় নদীর পাড়কে শক্ত বাঁধুনি দিয়ে আঁকড়ে রাখে। তার ফলে জলোচ্ছাসও কম হয়। পাড়েই ঢেউ ভেঙে যাওয়ায় উপকূলবর্তী এলাকার বাড়িঘরকে জলের তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।
কলকাতার উদাহরণ দিয়েই যদি দেখা যায়, তবে বঙ্গোপসাগরে তৈরি কোনও ঘূর্ণিঝড় কলকাতার উপরে আছড়ে পড়ার আগে তা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পাহারা পার করেই প্রবেশ করতে হয়। ম্যানগ্রোভের মোটা শিকড় এক্ষেত্রে জালের মতো কাজ করে। সুন্দরবনের গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্য বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প শোষণ করে নেয়। ফলে কলকাতায় পৌঁছতে পৌঁছতে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি অনেকটাই কমে যায়।
মৌসুনী, সাগরদ্বীপ, ফ্রেজারগঞ্জ, বকখালির মতো জায়গা, যেখানে ম্যানগ্রোভ অরণ্য কেটে জনবসতি, হোটেল, রিসর্ট গজিয়ে উঠেছে, সেখানে বুলবুলের সময়ই টের পাওয়া গিয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের দাপট কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।
দেশের ৭৫০০ কিলোমিটার উপকূলকে রক্ষা করে আসছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সমুদ্রের নোনা জল ও নদীর মিষ্টি লেক মিশ্রণে গজিয়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ যেকোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই টিকে থাকতে পারে। মূলত তিন ধরনের ম্যানগ্রোভ হয়- লাল, সাদা ও কালো। উপকূলবর্তী এলাকায় সাধারণত লাল ম্যানগ্রোভই দেখা যায়। কালো ছালের ম্যানগ্রোভ আবার বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে। অন্যদিকে সাদা ম্যানগ্রোভ গাছ আবার বাকি দুই ম্যানগ্রোভের প্রজাতির তুলনায় উচু জমিতে জন্মায়। ভারতে সুন্দরবন ছাড়াও গুজরাট, রত্নগিরি, গোয়া, কৃষ্ণা-গোদাবরী উপকূল এবং আন্দামান নিকোবরে ম্যানগ্রোভ অরণ্য দেখা যায়।
শুধুমাত্র ঝড়ের দাপট থেকে রক্ষাই নয়, বন্যার সময় জলস্তরের বৃদ্ধি কমানো থেকে শুরু করে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা কমানোর কাজও করে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ম্যানগ্রোভের ঘন ও মোটা শিকড় মাটির ভাঙন রোধ করে। দীর্ঘদিন ধরে ম্যানগ্রোভের শিকড়ের মাঝে জমা হয় মাটি, যা নদী বা সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থলভাগকে উচু করতে সাহায্য করে। এছাড়া বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস রোষণ করেও আমাদের রক্ষা করে ম্যানগ্রোভ। ছোট মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়ার ঘর এই ম্যানগ্রোভ।
হাজারো উপকারিতা জানা সত্ত্বেও নগরায়নের ঠেলায় আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। উপকূলবর্তী এলাকার উন্নয়নের নামে যথেচ্ছভাবে ম্যানগ্রোভ নিধন চলছে। চিংড়ি চাষের জন্যও ম্যানগ্রোভের ব্যবহার বিপদ বাড়াচ্ছে। এছাড়া দূষণ, প্লাস্টিক, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি ম্যানগ্রোভকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বের ৩৫ শতাংশ ম্য়ানগ্রোভ ধ্বংসের কারণ এগুলিই। ২০১১ সালে যেখানে ১০৩৮ স্কোয়ার কিলোমিটার উপকূল রক্ষা করত ম্যানগ্রোভ, ২০১৭ সালে তা ৯৯৯ স্কোয়ার কিলোমিটারে কমে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে ম্যানগ্রোভ রোপণ হলেও, তা মাত্র ৮ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হয়েছে। গ্রিন ট্রাইবুনাল ও আদালতের নির্দেশে কিছুটা রাশ টানা গেলেও বিপদ থেকে মুক্তি মিলছে কই?
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের সমীক্ষা অনুযায়ী, যেভাবে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হচ্ছে, তাতে সেই দিন খুব বেশি দূরে নেই যখন ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মলদ্বীপ তছনছ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত তলিয়ে যেতে পারে সমুদ্রের অতলে।
দক্ষিণ চিন সাগর, ভূমধ্যসাগরেও বিপদ ক্রমশ বাড়ছে। মালয়শিয়া, পাপুয়া নিউগিনি ও ফিলিপিন্সে ম্যানগ্রোভ আজ বিপন্ন হিসাবে চিহ্নিত। ম্যানগ্রোভ পুরোপুরিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে, যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলিও মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে।