কলকাতা: কোরিয়ান জ্বরে (Korean Fever) আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। কে-পপ মিউজিক (K-Pop Music), কে-ড্রামার (K-Drama) জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিদিন। কোরিয়ান সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে পাড়ার মোড়ে ছোট দোকান থেকে বড় বড় রেস্তোরাঁ খুলছে, যেখানে কোরিয়ান খাবার (Korean Food) বিক্রি হচ্ছে। পোশাক থেকে শুরু করে সাজসজ্জা-সেখানেও কোরিয়ার বিস্তৃত প্রভাব। রূপচর্চা বা স্কিন কেয়ারেও এখন কোরিয়ান স্কিন কেয়ারের (Korean Skin Care) দিকেই ঝুঁকছেন সকলে। ভারতীয়রা যেখানে দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে এত “অবসেসড’, সেখানে এটা কি জানেন কোরিয়ানরা ভারতীয়দের নিয়ে কী ভাবেন? বাংলাদেশি বা পাকিস্তানিদের নিয়ে?
আগে যেখানে বিদেশে ঘুরতে যাওয়া মানেই ছিল আমেরিকা বা ইউরোপ ভ্রমণ, সেখানেই এখন ট্যুরিস্ট ‘হটস্পট’ হয়ে উঠছে দক্ষিণ কোরিয়া। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখন কোরিয়ায় ঘুরতে যাচ্ছেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ানরা কী ভারতীয়দের খোলা হাতে স্বাগত জানাচ্ছেন? উত্তরটা হল ‘না’। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাণকেন্দ্র তথা রাজধানী সিওল(Soul)-র বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার পড়েছে, “ইন্ডিয়ান অ্যান্ড পাকিস্তানি নট অ্যালাওড”। দেইগু শহরেও বিভিন্ন জায়গায় লেখা, “মুসলিম ও হিন্দু আউট”। শুধু ভারতীয়ই নয়, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বিদেশিই বর্ণবিদ্বেষের শিকার হন। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যই উঠে এসেছে।
রাজ নামক ভারতীয় যুবক বিগত ৯ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকেন। ভ্লগিং করেন তিনি কোরিয়ার সংস্কৃতি, খাওয়া-দাওয়া সহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে। গত বছরই তাঁর কয়েকজন বন্ধু দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘুরতে আসে, তাদের নিয়ে ক্লাবিং করতে যান রাজ। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়। একটিও ক্লাবে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
এটা তো একটা ঘটনা। এরকম ভুরি ভুরি ঘটনা ঘটছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। নিত্যদিন হেনস্থা, বর্ণবিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন। কেমন সেই হেনস্থা? দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাসকারী এক ভারতীয় যুবতী জানান, সে যদি সাবওয়েতে বা বাস স্ট্যান্ডে ফাঁকা সিটে বসে, তবে বাকিরা পাশ থেকে উঠে যায়। ভারতীয়দের পাশে কেউ বসতে চায় না। বিদ্বেষ এতটাই গভীরে, যে দক্ষিণ কোরিয়ার শিশুদেরও মত, ভারতীয়দের ‘মাড’ অর্থাৎ কাদার মতো দেখতে।
এক সময়ে ব্রিটিশরা যেমন বর্ণবিদ্বেষ করত, এখন সেই জায়গা নিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এত শিক্ষিত দেশে কেন এমন বর্ণবিদ্বেষ? দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্য্যের মাপকাঠি বা “বিউটি স্ট্যান্ডার্ড” এতটা উচু যে কোরিয়ানরা নিজেরাই তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারেন না। কোরিয়ায় সরকারি চাকরির জন্য চাই টানা টানা সুন্দর চোখ ও উচু নাক। এমনকী, আপনার ব্রা-র সাইজ কত হবে, তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। সেই মাপকাঠিতে ‘ফিট’ হলেই আপনি সুন্দর। সকল কোরিয়ানরাই এই নিয়মে অভ্যস্ত। অল্প বয়স থেকেই শুরু হয়ে যায় রূপচর্চা বা ত্বকের যত্ন।
কোরিয়ান ভাষায় একে বলে “ওইমো জিসাং জুই”, যার ইংরেজি অর্থ হল লুকিজম (Lookism)। অর্থাৎ আপনার রূপ কেমন। চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতার সঙ্গে রূপকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই কারণে প্লাস্টিক সার্জারিও ব্যাপক জনপ্রিয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। স্কুল পাশ করলে আমাদের এখানে যেমন সাইকেল বা বাইক উপহার দেওয়া হয়, দক্ষিণ কোরিয়ায় উপহার দেওয়া হয় প্লাস্টিক সার্জারি (Plastic Surgery)। এমনকী দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রম মন্ত্রকের তরফেও বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হচ্ছে, চাকরি পাওয়ার জন্য প্লাস্টিক সার্জারি করুন।
বর্ণবিদ্বেষ রুখতে সরকারের তরফে চেষ্টা করা হলেও, বিশেষ কোনও লাভ হয়নি। বরং বর্ণ বিদ্বেষ রুখতে গেলে সরকারের গদি নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যায়। ২০১৬ সালে এমন আইন আনার চেষ্টা করা হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। বিল পাশও হয়। কিন্তু শেষ অবধি প্রতিবাদের মুখে পড়ে সরকার সেই বিল খারিজ করে দেয়।
সৌন্দর্য্য নিয়ে কোরিয়ানদের মধ্যে অদ্ভুত মোহ তো রয়েইছে। আরও একটি বড় কারণ হল শিক্ষা। দক্ষিণ কোরিয়ায় সাক্ষরতার হার ৯৮.৮ শতাংশ। সেখানেই বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ। শিক্ষিত যুবকরা কৃষিকাজ, নির্মাণ, মাংস প্রক্রিয়াকরণ, সাফাইকর্মীর মতো কাজ করতে রাজি নয়। সেই কারণে বাধ্য হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ব্লু কলার ওয়ার্কার আনানো হচ্ছে। তারাই কৃষিকাজ, নির্মাণকাজ করছেন।
বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১২ হাজার ভারতীয় থাকেন। বাংলাদেশ থেকেও বিপুল সংখ্যক কর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় কাজ করতে যান। বর্তমানে ১৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি কোরিয়ায় কাজ করেন। এছাড়া প্রতি বছর ১ লাখ পর্যটক যায়। তাদের মধ্যে অনেকেই এমন বিদ্বেষ মূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল, দক্ষিণ কোরিয়া এক সময়ে মনে করত, ভারত শত্রু দেশ। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ভারতের। আর দক্ষিণ কোরিয়া বরাবরই আমেরিকার বন্ধু দেশ। সেই কারণেই ভ্রান্ত ধারণা ছিল।