মুম্বই: প্রয়াত টাটা সন্সের চেয়ারম্যান এমেরিটাস রতন টাটা। শিল্পপতি হিসেবে তাঁর যতটা নাম, তিনি ঠিক ততটাই পরিচিত তাঁর জনহিতৈষী কাজের জন্য। তাঁর সাফল্যের কাহিনির গভীর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিকভাবে ভারতের অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভারতীয় ব্যবসায়ী জগতের নেতাদের অন্যতম। ২০১২ সালে অবসর নিয়েছিলেন, তার আগে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন ‘টাটা গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান-এর দায়িত্বে। বিতর্কহীন এই প্রবীণ শিল্পপতি, তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং কঠোর কর্ম সংস্কৃতির জোরে, তাঁর পারিবারিক ব্যবসাকে পরিণত করেছেন এক আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে। তবে, এতকিছু সত্ত্বেও, কোনোদিন তাঁর নাম ওঠেনি বিশ্বের প্রথম ১০ কি ২০ জন ধনকুবেরের তালিকায়। যে তালিকায় অম্বানি উঠলেন না, আদানি উঠলেন, তাই নিয়ে আলোচনা হয়। আসলে, তাঁর রোজগারের অধিকাংশটাই যেত জনহিতের কাজে। আর সেই কারণেই ১৪০ কোটির মানুষের দেশে তাঁর মতো সম্মানীয় ব্যবসায়িক নেতা আর একজনও নেই।
১৯৩৭ সালে বিখ্যাত টাটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রতন টাটা। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছিল। তাঁকে বড় করেছিলেন তাঁর ঠাকুমা। রতন টাটাকে ‘রত্ন’ হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অবদান সবথেকে বেশি। রতন টাটা একবার বলেছিলেন, “আমার ঠাকুমা আমাদের যে কোনও মূল্যে মর্যাদা বজায় রাখতে শিখিয়েছিলেন। এই মূল্যবোধ আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে রয়েছে।”
আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি এবং হার্ভার্ড অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের ডিগ্রি অর্জন করার পর, মোটা টাকার চাকরির ডাক এসেছিল আইবিএম থেকে। কিন্তু, সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রতন টাটা। বদলে, ১৯৬২ সালে টেলকো সংস্থায় সামান্য কর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করেছিলেন। বেলচা ব্লাস্ট চুল্লিতে দলের সদস্য হিসেবে বেলচা দিয়ে চুনাপাথর তুলতে হত। এরপর টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থায় বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন রতন টাটা। অবশেষে ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল রেডিয়ো অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বা নেলকোর (NELCO) এর ডিরেক্টর হন। শিক্ষানবিশ থেকে ডিরেক্টর হতে তার নয় বছর লেগেছিল, কিন্তু তিনি কঠোর পরিশ্রম করা থেকে কখনই পিছিয়ে যাননি। আর সেই কারণেই সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তবতা ধরতে তাঁর কখনও অসুবিধা হয়নি।
আজ, ভারতে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে টাটা ব্র্যান্ডের কোনও পণ্য বা পরিষেবা নেই। টাটার কোনও পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহার করেনি এমন কোনও ভারতীয় পাওয়া কঠিন। নুন থেকে মোটরগাড়ি, ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে টাটা ব্র্যান্ড। টাটা ব্র্যান্ডের এই সর্বব্যপ্তি ঘটেছিল রতন টাটার সময়েই। ১৯৯১ সালে, জেআরডি টাটার হাত থেকে টাটা সন্স এবং টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রতন টাটা। সেই সময় থেকেই তিনি টাটা গ্রুপের পুনর্গঠন শুরু করেছিলেন। একই সময়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে লেগেছিল উদারীকরণের হাওয়া। রতন টাটার নেতৃত্বে বিশ্বায়নের বাজারে তরতরিয়ে বেড়েছিল টাটা গোষ্ঠী।
টেটলি, কোরাস, জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার, ব্রুনার মন্ড, জেনারেল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট, ডেইউ – নতুন সহস্রাব্দে একের পর এক বড় সংস্থা অধিগ্রহণ করেছে টাটা গোষ্ঠী। রতন টাটার বিচক্ষণ নেতৃত্বে এই সাহসী পদক্ষেপগুলি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল টাটা গোষ্ঠীকে। ১০০টিরও বেশি দেশে পৌঁছে গিয়েছিল টাটা। বিশ্বজুড়ে হোটেল, রাসায়নিক সংস্থা, কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং শক্তি সংস্থা এসেছিল টাটা গোষ্ঠীর আওতায়। ঝুঁকি নিতে তিনি কখনও পিছিয়ে আসেননি। তিনি বলতেন, “সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল কোন ঝুঁকি না নেওয়া।”
মানুষের চাহিদা এবং দৈনন্দিন জীবনকে খুব ভালভাবে বুঝতেন তিনি। সকল ভারতীয় রাস্তায় চোখে পড়বে টাটা ট্রাক, বাস বা এসইউভি। বিশ্বের সবথেকে সস্তা গাড়ি হিসেবে টাটা ন্যানোর নকশা করেছিলেন তিনি। এই গাড়ির প্রসঙ্গে রতন টাটা বলেছিলেন, “আমার মনে আছে বম্বেতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে একটি মোটরবাইকে চারজনের এক পরিবারকে আমি যেতে দেখেছিলাম। বিকল্পের অভাবে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখনই আমার মনে হয়েছিল, এই পরিবারগুলির জন্য আমার কিছু করা উচিত।”
ব্যবসায়িক লাভের বাইরেও কিছু করার কথা ভাবতেন তিনি। তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি অটুট প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর। ২০২১-এ ভারতের ধনীদের তালিকায় তিনি ছিলেন ৪৩৩তম স্থানে। কারণ ভারতের সবথেকে বড় সমাজসেবীদের একজনও ছিলেন রতন টাটা। ভারতের অন্যতম বৃহৎ দাতব্য সংস্থা হল তাঁরটাটা ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, গ্রামোন্নয়ন – সমস্ত ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এবং বিভিন্ন আইআইএম ক্যাম্পাসে অর্থ প্রদান করেছে টাটা ট্রাস্ট। কোভিডের সময় অবলীলায় ব্যক্তিগতভাবে ৫০০ কোটি টাকা দান করেছিলেন রতন টাটা। মুম্বইয়ে ২৬/১১ জঙ্গি হামলার পর, হতাহতদের পরিবারদের পুনর্বাসনে সাহায্য করার জন্য ‘তাজ পাবলিক সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ গঠন করেছিলেন তিনি।
অবসরের পর যে কোনও সাধারণ মানুষের জীবন কাটে বিশ্রামে। কিন্তু, অশীতিপর শিল্পপতি বলতেন, অবসর জীবন গলফ খেলে কাটানোর জন্য নয়। একটি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। স্টার্টআপটি তাঁর শেষ বয়সের সহকারী, শান্তনু নাইডুর। স্টার্টআপটি প্রবীণ নাগরিকদের একাকীত্ব কাটাতে সহায়তা করে। তরুণ গ্র্যাজুয়েটরা তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। লেন্সকার্ট, পেটিএম, ওলা ইলেকট্রিক মোবিলিটি এবং আপস্টক্সের মতো ৫০টিরও বেশি স্টার্টআপ সংস্থাকে আর্থিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন রতন টাটা।
কুকুর ও অন্যান্য পোষ্যদের প্রতি, তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। টাটা সন্সের গ্লোবাল হেডকোয়ার্টার, বম্বে হাউসে বেশ কিছু পথকুকুর থাকে। তাদের দেখাশোনা করে টাটা সন্স সংস্থা। প্রতিকূল আবহাওয়ায়, পথকুকুররা নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিত তাজ হোটেলে। সম্প্রতি, মুম্বইয়ে কুকুর ও অন্যান্য পোষ্যদের জন্য একটি হাসপাতালও স্থাপন করেন রতন টাটা। এমনকি, শান্তনু নাইডুর সঙ্গে রতন টাটার যোগাযোগও হয়েছিল কুকুরের প্রতি তাদের দুজনের ভালবাসার মাধ্যমেই। শান্তনু তাঁর প্রথম স্টার্টআপ, মোটোপস-এর জন্য তহবিল চেয়েছিলেন রতন টাটার কাছে। এটি ছিল প্রতিবন্ধী পথ কুকুরদের সহায়তার জন্য এক সামাজিক উদ্যোগ।
একেবারে নীচুতলা থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায়, তিনি কর্মীদের চাহিদাও বুঝতেন। তাঁদের কল্যাণের কথা সবসময় ভেবেছেন। ২০২১ সালে, সোশ্যাল মিডিয়ায় রতন টাটার এক ঘটনা অত্যন্ত ভাইরাল হয়েছিল। মুম্বই থেকে তিনি পুনে গিয়েছিলেন একজন প্রাক্তন কর্মীর সঙ্গে দেখা করতে। খবর পেয়েছিলেন, তিনি গত দুই বছর ধরে অসুস্থ। তারপরই রওনা দিয়েছিলেন পুনেতে।
শিল্প ক্ষেত্রে ও সমাজে তাঁর অবদানের জন্য বহু সরকারি-বেসরকারি স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ২০০০ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ এবং ২০০৮ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণে সম্মানে ভূষিত করা হয়। ভারত ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেটও পেয়েছেন তিনি।
এমনই এক বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন রতন টাটা, যার উত্তরাধিকার ছড়িয়ে রয়েছে ভারত ও বিশ্বের আনাচে-কানাচে।