‘কোন গোপনে মন পুড়েছে বৃষ্টি থামার পরে, আমার ভিতর ঘরে’
মনের কোণে যে মেঘ জমে, সেই খবর কে আর রাখে? জমিয়ে রাখা সেই কষ্ট, অভিমানই পাহাড়ে পরিণত হয়। তারপর একদিন… সব শেষ। মনের মেঘ নিম্নচাপে পরিণত হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। তার সঙ্গে ঝরে যায় প্রাণও। বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যে অধিকাংশই আবার জীবনযুদ্ধে হার মানছে প্রেমের কাছে। অবাক হচ্ছেন? এটাই কিন্তু বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রেকর্ড। ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী,শুধু ২০২১ সালেই ১৪৯৫ নাবালক আত্মহত্যা করেছে প্রেমের সম্পর্কের কারণে। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ১৩৩৭। অর্থাৎ এক বছরেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ১১.৮১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই আত্মহত্যা বাড়ছে কেন? একজনকে ভালবেসে কেউ সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারে, এই গল্প আমরা পড়ে এসেছি বইয়ের পাতায়। তাহলে যে প্রেম মানুষকে জীবনের দিশা দেখায়, সেই প্রেম হঠাৎ করে বিষিয়ে উঠছে কেন?
হীর রাঞ্চা থেকে শুরু করে লায়লা-মজনু বা রোমিও-জুলিয়েট,তাদের প্রেমের সামনে হার মেনেছিল জীবন। তাদের প্রেমের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। সকলে প্রেমের উদাহরণ দিতে এদের কথাই বলেন। প্রেম তো মনের পবিত্র একটা অনুভূতি। তবে তার কারণে প্রাণ যাবে কেন? এর পিছনে লুকিয়ে থাকে নানা কারণ। যেমন রয়েছে পরিবারের আপত্তি, তেমনই লুকিয়ে থাকে সম্পর্কের জটিল সমীকরণ।
প্রেম নিয়ে একটা ট্যাবু বা রাখঢাক ব্যাপার ছিল বরাবরই। ১০ বা ২০ বছর আগেও যখন কারোর প্রেমের সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যেত, তখন বাড়ির লোকের কাছে ঠ্যাঙানি জুটত, তেমনই সামাজিক বয়কট, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া, এমনকী অনার কিলিংয়ের মতো ঘটনাও ঘটত। এখন প্রচার, সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমের দৌলতে হয়তো সম্মান রক্ষার্থে খুনের মতো ঘটনা কমলেও, তা সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা যায়নি।
বাড়ির মহিলা বা বয়স্কদের অনেক সময়ই ভ্রু কুঁচকে বলতে শোনা যায়, “এখনকার ছেলেমেয়েদের দেখো, অল্প বয়সেই প্রেম করে। আমরা তো বাপু এমন ছিলাম না”। সমস্যার শুরুটা এখান থেকেই। প্রেম তো আগেও করত সবাই। এখন সময় বদলেছে। তার সঙ্গে বদল এসেছে সবকিছুতেই। ৩-৪ বছর বয়সে যখন হয়তো আমরা আদো আদো কথা বলতাম, সেখানেই আজকের যুগের ছেলেমেয়েরা ওই বয়সে মোবাইল ঘাঁটতে এক্সপার্ট। অল্প বয়সেই হাতে মোবাইল ও ইন্টারনেট থাকায়, আজকের যুগের শিশু, কিশোর-কিশোরীরা অনেক বেশি ‘অ্যাডভান্সড’। টিভি, সিনেমাতেও সবসময় প্রেমের গল্প দেখা যায়। বাচ্চারা তো সেটা দেখেই বড় হয়। তাহলে তারা কেন প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে জানবে না বা বুঝবে না?
১৩ -১৪ বছর বয়সে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় সবাই। শারীরিক যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনই মানসিক পরিবর্তনও আসে। বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরেও বাকি সম্পর্কের বিষয়ে বুঝতে শেখে। স্বাভাবিকভাবেই প্রেম-ভালবাসা সম্পর্কে বুঝতে শেখে। কিন্তু এই সময়ে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাও দেওয়ার সময়। অভিভাবকরা স্বাভাবিকভাবেই সন্তানদের ভাল চাইবেন। তাই অন্যদিকে মন না দিয়ে, তাদের মনোযোগ যেন পুরোটাই পড়াশোনার উপরে থাকে, তাই চান। প্রেম না পড়াশোনা- এই বিরোধ থেকেই সমস্যার শুরু হয়। সেই সমস্য়া বাড়তে বাড়তেই শেষ পর্যায়ে আত্মহত্যায় পৌঁছয়।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, হতাশা, পারিবারিক সমস্যা, প্রেমে বিচ্ছেদ, দারিদ্রতা, হেনস্থা, যৌন হেনস্থা, সামাজিক বয়কটের মতো নানা সমস্যার কারণে অল্পবয়সীরা অনেক সময় হাল ছেড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। কেন এই হতাশা? প্রেম যেখানে ভরসার নিশ্চিত ঠিকানা হয়ে ওঠার কথা, সেখানেই অনেকের কাছে বোঝা হয়ে উঠছে এই সম্পর্ক। অপরিণত চিন্তাভাবনা সমাজের জটিল হিসাব, নিয়ম কানুন বুঝতে পারে না। তাই বিচ্ছেদের শোক বা প্রেমে ঠকানোর ধাক্কা সহ্য করতে না পেরেই অনেক কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ করছে।
চলতি বছরেই একটি এক্সপোয় “স্টুডেন্ট সুইসাইড: অ্যান এপিডেমিক সুইপিং ইন্ডিয়া” শীর্ষক রিপোর্টে তুলে ধরা হয় যে বর্তমানে কৃষকদের তুলনায় পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, যেখানে দেশে বার্ষিক আত্মহত্যার হার ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানেই পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ৪ শতাংশ বেড়েছে। পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার হারে শীর্ষে রয়েছে মহারাষ্ট্র। এরপরেই রয়েছে তামিলনাড়ু, মধ্য প্রদেশ। দেশে মোট পড়ুয়াদের আত্মহত্যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই এই তিন রাজ্যের।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে ৫৬,২৪০ জন আত্মহত্যা করেছেন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা কলহের কারণে। সেখানেই ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১৫,৪৯৯ জন খুন হয়েছেন প্রেমের সম্পর্কের কারণে।
বর্তমানে যে হারে আত্মহত্যা বাড়ছে, তার অন্যতম কারণ হিসাবে মনোবিদরা বলছেন, জটিল সম্পর্কের সমীকরণ। আগে প্রেম বলতে আমরা নারী-পুরুষের সম্পর্কই বোঝাত। তবে এখন প্রেমেও অনেক ভাগ রয়েছে। সিচুয়েশনশিপ, বেঞ্চিং , ব্রেড ক্রাম্বিং, ফ্রেন্ডস উইথ বেনেফিট- এখন সম্পর্কের নানা নাম রয়েছে। কোনও সম্পর্কে প্রেম নাম না পেলেও, বাকি যাবতীয় কিছুই থাকে। কোনও সম্পর্কে আবার নিজের ভাবনা এতটাই বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায় যে উল্টোদিকের মানুষটা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। কেউ আবার এই মুহূর্তেই সম্পর্কে আছেন তো পরের মুহূর্তেই সিঙ্গেল। সহজ কথায় বলতে গেলে আজকের প্রেমের সংজ্ঞা বদলেছে। শুধু বছর বছর নয়, এক মাস, একদিনের প্রেমও গড়ে উঠছে। মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে সম্পর্কের নাম।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে হাজার হাজার বন্ধু থাকলেও, রিয়েল লাইফে সকলেই বড় একা। সম্পর্কের ওঠাপড়া, ভাঙা-গড়ার মধ্যে মনের কথা ভাগ করার কেউ থাকে না। সেখান থেকেই সমস্যা বাড়ে। মনের ভিতরে গুমরে গুমরে জমা থাকা অভিমান একদিন বন্যা হয়ে আসে। মনোবিদদের কথায়, আসলে অল্প বয়সে যেহেতু ম্যাচুরিটি বা পরিণত চিন্তাভাবনা তৈরি হয় না, তাই অনেকেই সম্পর্কে লঘু করে দেখেন। কেউ কেউ আবার ওই সম্পর্ককেই তার গোটা পৃথিবী বানিয়ে নেন। এই মানসিকতার পার্থক্যের জন্য সম্পর্ক ভেঙে যায়। আর সেই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরেই অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
আত্মহত্যা যেমন সামাজিক ব্যধি, তেমনই পরিবারের সম্মান রক্ষার্থের খুনের মতো ঘটনাও কিন্তু ভারতে কম নয়। বিশেষ করে হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহারের মতো উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে ‘অনার কিলিং’ বা সম্মান রক্ষার্থে খুনের ঘটনা প্রায়সময়ই সামনে আসে। আইন কঠোর করেও এই ব্যধিতে এখনও ইতি টানা সম্ভব হয়নি। আগে অনার কিলিংয়ের ঘটনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ঘটত। অন্যান্য রাজ্যেও প্রেমে জানাজানি হলে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেওয়া, সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়ার মতো ঘটনা প্রায় প্রতি পাড়াতেই শোনা যেত।
অন্যদিকে আবার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেও আত্মহত্যা, খুনের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। স্বামী বা স্ত্রীর গোপন সম্পর্ক জানতে পেরে বচসা, অশান্তির কারণেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কেউ আবার দ্বিতীয় সম্পর্কে জড়ানোর জন্য স্ত্রী বা স্বামীকে খুন করতেও পিছপা হন না।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের কারণে ৩০,০১২ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৫১.৬ শতাংশ খুনই প্রেমের সম্পর্কের কারণে। ৪৬.৬ শতাংশ খুন হয়েছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে। ১.৭ শতাংশ খুন হয়েছে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে।
খুন বা আত্মহত্যার ঘটনার পিছনে এখন অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শারীরিক সম্পর্ক। প্রেমের সম্পর্কে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া কোনও অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে সম্পর্ক ভাঙার পর সামাজিক লজ্জায় আত্মহত্যা করে নেন। সম্পর্ক ভাঙার পর পুলিশে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ জানান অনেকে। সেই লজ্জাতেও আত্মহত্যার উদাহরণ রয়েছে।
শারীরিক সম্পর্ক এবং যৌনতা নিয়ে যাতে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আরও সচেতন ধারণা তৈরি হয়, তার জন্য ২০১২ সালে ‘প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্স’ বা পকসো (POCSO) আইনের অধীনে যৌন সম্মতির বয়স ১৬ থেকে বাড়িয়ে ১৮ বছর করা হয়।
এছাড়া, ২০১৫ সালে জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টেও সংশোধন করা হয়। এই আইন সংশোধন করে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদেরও কিছু বিশেষ মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে গণ্য করা হয়। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের মতো বহু অপরাধের ঘটনাতেই অনেক সময় অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায় শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায়। এই বিষয়ে পরিবর্তন আনতেই এই সংশোধন।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারেরও পরিকল্পনা রয়েছে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করার। এই প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। তবে কঠোর আইন বা মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে যতই গুরুত্ব দেওয়া হোক না কেন, এই সংখ্যাগুলি কোথাও যেন প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে যে সময় এগোলেও, সমাজ কি এগোচ্ছে? আজ মা-বাবার কাছে প্রেমের কথা বা গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া অনেক সহজ হলেও, তা কি প্রেমকে স্বীকৃতি দিচ্ছে? তাহলে কেন বাড়ছে আত্মহত্যার হার?