ত্রিপুরা ‘উদ্ধারে’ মুকুল-অস্ত্রেই ধার তৃণমূলের, ঘর বাঁচাতে আরএসএসের শরণে বিজেপি

Jun 17, 2021 | 5:39 PM

মুকুল ঝরায় বিজেপি (BJP) যে ভালই ধাক্কা খেয়েছে, তা মুখে স্বীকার না করলেও আচরণে বুঝিয়েছে ইতিমধ্যেই। কেন্দ্রীয় নেতা বিএল সন্তোষের নেতৃত্বে ত্রিপুরায় চার সদস্যের একটি দলও পাঠিয়ে ফেলেছে বিজেপি।

ত্রিপুরা উদ্ধারে মুকুল-অস্ত্রেই ধার তৃণমূলের, ঘর বাঁচাতে আরএসএসের শরণে বিজেপি
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ

Follow Us

সৌরভ গুহ: একুশের বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের পর ধীরে ধীরে সংগঠনের ভোল বদলে তৃণমূলকে আরও সুদৃঢ় করে তুলছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু বাংলাই নয়, নজর এবার সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও। বিধানসভায় হ্যাটট্রিক তো হয়েই গিয়েছে। এবার জাতীয় রাজনীতিতেও ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে চাইছে ঘাসফুল। তবে মাপা পদচারণ। একে বারে ‘স্টেট টু স্টেট মার্কিং’-এ এগোতে চাইছে তারা। এই কৌশলে একদম প্রথমেই নাম রয়েছে ত্রিপুরার। শোনা যাচ্ছে, আবারও এই ত্রিপুরার দায়িত্ব মুকুল রায়কেই দিতে চান তৃণমূল সুপ্রিমো।

সময়টা ছিল ২০০৫ সাল। বাইরের রাজ্যে সংগঠন করার লক্ষ্যে ত্রিপুরায় পা রাখে তৃণমূল কংগ্রেস। ত্রিপুরার ঘরোয়া রাজনীতিতে তখন মধ্যগগনে বামফ্রন্ট। কোণঠাসা কংগ্রেস গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। সে রাজ্যে রাজনীতির এই ‘বিরোধী হীন’ পটকে কাজে লাগিয়ে দু’ বছরের মধ্যেই সংগঠন তৈরিতে সমর্থ হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল।

২০০৬-২০০৭ সাল নাগাদ তৃণমূলে যোগ দেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুধীররঞ্জন মজুমদার। যোগ দেন কংগ্রেস জমানার আরেক মন্ত্রী রতন চক্রবর্তী। কিন্তু খুব বেশিদিন সে সংগঠন স্থায়ী হয়নি। তৃণমূল ছেড়ে বহু নেতা-ই পুরনো দলে ফিরে যান। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য ‘পরিবর্তনের যাত্রা’ সূচিত করে পশ্চিম বাংলায়। যদিও ত্রিপুরার রাজনীতিতে খাতা খুলেও সেবার সাফল্য অধরাই থেকে গিয়েছিল তৃণমূলের। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে অরুণাচল প্রদেশ এবং মণিপুরে। ২০০৯ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বেশ কয়েকজন তৃণমূল প্রার্থী বিধায়ক হন এই দুই রাজ্যে। তৈরি হয় পরিষদীয় দলও। মেঘালয়ে তৈরি হয় তৃণমূলের ইউনিট।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ ধনখড়ের, ‘ছোট ছেলে হলে বকাঝকা করা যায়’, বললেন মমতার

২০১৪ সালে আবারও ত্রিপুরায় নজর দেয় তৃণমূল। সে বছর লোকসভা ভোটে ত্রিপুরার দু’টি লোকসভা আসন থেকে লড়েন রতন চক্রবর্তী এবং ভৃগুরাম রিয়াং। ওই বছরই তৃণমূলে যোগ দেন ত্রিপুরার বর্ষীয়ান কংগ্রেস বিধায়ক সুরজিৎ দত্ত। এরপর ২০১৬ সাল। ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সমীর রায়বর্মনের ছেলে বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মন (বর্তমানে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী )-সহ পাঁচ কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূলের সদস্য হন। ২০১৬ সালে আগরতলার আস্তাবল মাঠের সভায় বক্তব্য রাখেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ত্রিপুরা বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হন তৃণমূল কংগ্রেসের সুদীপ রায়বর্মন। সংগঠনও বাড়তে থাকে ঘাসফুলের।

কিন্তু এসবের মধ্যেই ছন্দপতন ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। মুকুল রায় ঘোষণা করেন তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়ছেন। এদিকে এই মুকুলের হাতেই ত্রিপুরা, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশে সংগঠন ঢেলে সাজানোর ভার দিয়েছিলেন মমতা। ফলে সে সময় ঘাসফুল থেকে মুকুল ঝরতেই টলমল হয়ে যায় তৃণমূলের সংগঠনও। কিছুদিন পরই সুদীপ রায়বর্মন-সহ বেশ কয়েকজন নেতা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। ধাক্কা খায় ত্রিপুরায় তৃণমূলের পথ চলা। অন্যদিকে মুকুলের তৈরি করা সংগঠনকে তুরুপের তাস করেই গেরুয়া হাওয়া বইতে শুরু করে সে রাজ্যে।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পরই দলকে অন্যান্য রাজ্যে বিস্তার ঘটানোর ঘোষণা করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলকে আশাপ্রদ ফলাফল দেওয়ার অন্যতম কারিগর হিসেবে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই অভিষেক একটা বিষয় স্পষ্ট করেন, শুধু অস্তিত্ব জানান দেওয়া তৃণমূলের লক্ষ্য নয়, জেতার জন্যই রাজ্যে রাজ্যে যাবে তৃণমূল।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এরপরই আলোচনায় উঠে এসেছে ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বের সাত রাজ্যের নাম। সূত্রের খবর, কিছুদিনের মধ্যেই ত্রিপুরা ও অন্যান্য রাজ্যে যাবে তৃণমূলের প্রতিনিধি দল। ত্রিপুরায় আবার বিজেপির বিপ্লব দেবের সঙ্গে সুদীপ রায়বর্মনের দ্বন্দ্ব চরমে। ফলে মুকুল তৃণমূলে ফিরতেই সুদীপ তাঁর দলবল নিয়ে আবারও ঘাসফুলে ভিড়ে যেতে পারেন। তা নিয়ে জল্পনাও চলছে বিস্তর। ত্রিপুরা রাজনীতিতে এখন বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছেন প্রদ্যোৎকিশোর মানিক্য দেব বর্মন। আঞ্চলিক একটি দলও গড়েছেন তিনি। এই দল উপজাতি অঞ্চলের স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা এটিসি নির্বাচনে ভালো ফল করে । ফলে এই নবীন নেতা তাঁর নতুন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে তৃণমূলের জোট করবেন, নাকি অন্য কোনও দলের দিকে যাবেন তাও এখন আলোচনার বিষয় গোটা ত্রিপুরায়।

তবে তৃণমূল কিন্তু সে রাজ্যে আবারও কোমর বেঁধে নামছে। এমনও শোনা যাচ্ছে, বিজেপি-পর্বের আগে যে ‘চাণক্যে’ ভরসা রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিপুরায় বাজিমাত করেছিলেন, সেই মুকুল রায়ের হাত ধরেই ‘ত্রিপুরা উদ্ধারে’ নামবে তৃণমূল। ত্রিপুরা তৃণমূলের প্রেসিডেন্ট আশিস লাল সিং ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, “তৃণমূলই বিজেপি অপশাসনের হাত থেকে ত্রিপুরাকে রক্ষা করবে।” বিপ্লব দেবের ‘অপশাসনে’ মানুষ হতাশ বলেও দাবি আশিস লালের। বাংলায় হ্যাটট্রিকের পরই তৃণমূলে যোগদান বেড়েছে। তলে তলে অনেকে যোগাযোগও করছে বঙ্গ তৃণমূলের সঙ্গে। শোনা যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি রাজ্যে আসতে পারেন ত্রিপুরার বেশ কয়েকজন বিধায়ক।

মুকুল ঝরায় বিজেপি যে ভালই ধাক্কা খেয়েছে, তা মুখে স্বীকার না করলেও আচরণে বুঝিয়েছে ইতিমধ্যেই। কেন্দ্রীয় নেতা বিএল সন্তোষের নেতৃত্বে ত্রিপুরায় চার সদস্যের একটি দলও পাঠিয়ে ফেলেছে বিজেপি। ২০২৩ সালেই ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে দলের ভাঙন রুখতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। দিল্লিতে একপ্রস্থ বৈঠকও হয়েছে ত্রিপুরা নিয়ে। একা বিজেপিতে কতটা কাজ হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। তাই আবার ঘর সামলাতে আসরে নেমেছে আরএসএস-ও। লক্ষ্য একটাই, বিজেপির বিদ্রোহীদের শান্ত করে ঘর বাঁচানো। এতদিন বিজেপি বিরোধিতা সামলানোই ছিল ত্রিপুরায় বিজেপির চ্যালেঞ্জ। এখন আবার নয়া ‘হুমকি’ তৃণমূল। মুকুল রায়কে সৈনিক করে যদি আবারও উত্তরপূর্বে পাঠানো হয় তা হলে সে লড়াই যে খুব একটা সহজ হবে না তা হাড়ে হাড়ে জানে পদ্মশিবির।

Next Article