বঞ্চনার অভিযোগ তুলে ২০২১ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মজয়ন্তীতে দেশের চার জায়গায় রাজধানী করার দাবি তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার এই দাবি নিয়ে সে সময় জোর রাজনৈতিক তর্জা শুরু হয়। সোমবার ফের দেশে একাধিক রাজধানী হওয়ার দাবি উঠল। তবে আর বাংলা থেকে নয়। তাৎপর্যপূর্ণভাবে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকেই সেই দাবি ওঠে। বিজেপি শাসিত অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার গলায় শোনা গেল সেই দাবি। তিনি প্রশ্ন তুললেন, দেশে পাঁচটি রাজধানী কি করা যায় না? ১৪০ কোটির দেশ ভারত। যার আয়তন মালয়েশিয়ার দশ গুণ বা দক্ষিণ আফ্রিকার তিন গুণ। এই বিশাল জনবহুল দেশের একটিই মাত্র রাজধানী। কিন্তু মাত্র তিন কোটি জনসংখ্যার মালয়েশিয়ার কিংবা ৬ কোটি জনসংখ্যার দক্ষিণ আফ্রিকার আবার একাধিক রাজধানী। একাধিক রাজধানী হলে আদৌ কি কোনও সুবিধা হয়? অসুবিধাই বা কী কী? মালয়েশিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশেও কেন একাধিক রাজধানী করা হয়েছে? ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকেই কেন বারবার একাধিক রাজধানী হওয়ার দাবি উঠছে? চলুন খোঁজা যাক, এসব প্রশ্নের উত্তরগুলি।
বিশ্বের যে সব দেশে একাধিক রাজধানী:
অধিকাংশ দেশ বলা ভুল হবে, বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশেই একাধিক রাজধানী রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ আফ্রিকার ৩টি (প্রিটোরিয়া, কেপ টাউন, ব্লোয়েমফনটেইন) ছাড়া বলিভিয়া (সুক্রে, লা পাজ়), এসওয়াটিনি (এমবাবানে, লবাম্বা), মালয়েশিয়া (পুত্রাজায়া, কোলা লামপুর), শ্রীলঙ্কা (কলম্বো, শ্রী জয়বর্ধনেপুরা কোত্তে) ও বেনিনে (পোর্তো-নোভো, কোটোনৌ) দুটি করে রাজধানী রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় রাজধানী। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রশাসনিক, আইন এবং বিচার বিভাগীয় রাজধানী রয়েছে।
কেন একাধিক রাজধানী?
দক্ষিণ অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে শায়িত ১২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানীগুলির ভৌগলিক অবস্থান দেখলেই, এর উত্তর মিলবে। দক্ষিণ আফ্রিকার একদম দক্ষিণে সৈকত শহর কেপ টাউন। সেখানেই রয়েছে হাউস অব পার্লামেন্ট। আবার ব্লোয়েমফনটেইন রাজধানী দেশের কেন্দ্রবিন্দুতে। সাড়ে পাঁচ লক্ষের জনবসতি এখানে। দক্ষিণ আফ্রিকার সুপ্রিম কোর্ট এখানেই অবস্থিত। আর একদম উত্তরে পাহাড়-নদী ঘেরা প্রিটোরিয়া। সেখান থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো হয়। যাবতীয় বিদেশি দূতাবাস সব এখানেই। দেশের ভৌগলিক দিক মাথায় রেখে সুষ্ঠুভাবে আইন, বিচার এবং প্রশাসন চালানোর জন্য একাধিক রাজধানী করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়।
ভারতেও এক সময় ছিল একাধিক রাজধানী
দেশ পরিচালনার জন্য সুদূর বঙ্গোপসাগরের কোলে গঙ্গা তীরবর্তী কলকাতাকেই রাজধানী হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। সময় ১৭৭২। রানি ভিক্টোরিয়ার জমানাতেও একই ব্যবস্থা বহাল ছিল। তবে, ১৮৬৪ সালে কলকাতা ছাড়াও হিমালচল প্রদেশের শৈলশহর সিমলাকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করে ব্রিটিশ সরকার। সেই প্রথম জোড়া রাজধানী দেশে। এরপর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। কলকাতা রাজধানী হওয়ায় চরমে ওঠে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর জেরে কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করে নিয়ে যাওয়া হয় বাদশাহি রাজ্য দিল্লিতে। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত জোড়া রাজধানীই বহাল ছিল ভারতে।
একাধিক রাজধানী করার পিছনে মমতা ও হিমন্তের যুক্তি
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, দেশের চারটি প্রান্তে চারটি রাজধানীর। সেগুলি হল দক্ষিণ, উত্তর, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “দিল্লিতে কী আছে? কেন একটা জায়গায় সংসদ সমীবাদ্ধ থাকবে?” তাঁর আরও মন্তব্য, “ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারটি জায়গায় অধিবেশন হোক। আমরা সকলের জন্য বলছি। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ওয়ান লিডার, ওয়ান নেশনের মূল্য কী আছে?” বিশেষজ্ঞদের মতে, আসলে দিল্লির ক্ষমতা বেকেন্দ্রীকরণের দাবি তোলেন মমতা।
অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, “দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল এখন অন্য রাজ্যকে উপহাস করা অভ্যাসে পরিণত করেছেন। তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদের পরে, আমার মনে হয়েছে, দরিদ্র রাজ্যগুলিকে উপহাস না করে, আমাদের বৈষম্যের রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে কাজ করা উচিত। আমরা কি ভারতের ৫টি রাজধানী পেতে পারি না, প্রতি জ়োনে একটি করে?”
একাধিক রাজধানীর সুবিধা ও অসুবিধা
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, একাধিক রাজধানীর বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। বিশেষ করে ভারতের মতো বৃহৎ জনবহুল দেশে একাধিক রাজধানী অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ভারতের ভৌগলিক এবং সংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এত বেশি প্রকট, একাধিক রাজধানী হলে প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। ভারতীয় রেলের উদাহরণ টেনে আনছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, রেলে বিভিন্ন জ়োন থাকায় প্রতিদিন সুষ্ঠুভাবে পরিষেবা পান লক্ষ লক্ষ যাত্রী। ঠিক তেমনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাজধানী থাকলে, প্রান্তিক নাগরিকের দুয়ারে সরকারি পরিষেবা পৌঁছে যাবে সহজে।
তবে, বিশেষজ্ঞদের অন্য অংশের দাবি, ভারত যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে, তাই একাধিক রাজধানীর দাবি অপ্রসাঙ্গিক। সরকারি সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্রের হাত ধরে রাজ্য সরকার থেকে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছয়। বিচার বিভাগ এবং আইন বিভাগ রাজ্যের হাতেও রয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ মনে করছেন, একাধিক রাজধানী থাকার বিড়ম্বনাও রয়েছে। তাঁদের মতে, দেশের চার চারটি সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চয়ই থাকবে না। চারটি পার্লামেন্ট থাকার খরচও অযৌক্তিক। যদি সুপ্রিম বিচার বিভাগ দিল্লি থেকে সরে কর্নাটকে স্থানান্তরিত হয়, তাতে অসম বা বাংলার বাড়তি কোনও সুবিধা নেই। বরং অসুবিধাই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় প্রশাসন, আইন এবং বিচার ব্যবস্থা যে ভাবে বিন্যস্ত রয়েছে, একাধিক রাজধানীর দাবির চেয়ে এই ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলাই বেশি উপযোগী বলে মনে করছেন তাঁরা।
জম্মু-কাশ্মীরে রাজধানী বিতর্ক
এই মুহূর্তে ভারতে একমাত্র জম্মু-কাশ্মীরেই দুটি রাজধানী রয়েছে। শ্রীনগর ও জম্মু। এই দুটি রাজধানী করার পিছনে স্বাধীন দেশের সেভাবে ভূমিকা না থাকলেও আজও বহাল তবিয়তে এই ব্যবস্থাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শ্রীনগর এবং নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জম্মুকে রাজধানী (দরবার) হিসাবে ব্যবহার করা হয়। শুধুই প্রশাসনিক দফতর নয় বিচার ব্যবস্থাও স্থানান্তরিত হয়। শ্রীনগর ও জম্মু রাজধানী হওয়ার পিছনে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।
উনবিংশ শতাব্দীতে জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজা রণবীর সিং প্রথম শ্রীনগরকে দ্বিতীয় রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পিছনে একটি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, ১৮৪৬ সালে অমৃতসর চুক্তি হওয়ার পর জম্মুর পাশাপাশি কাশ্মীরও ডোগরা রাজত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। মনে করা হয়, কাশ্মীরের মানুষদের খুশি রাখতে শ্রীনগরকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করে ৬ মাস অন্তর রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয়। সেই থেকেই আজও চালু হয়ে আসছে এই ব্যবস্থা।
১৯৮৭ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা শ্রীনগরকেই জম্মু-কাশ্মীরের একমাত্র রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের পর চরম রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় ফারুক আবদুল্লাকে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, শীতকালে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে শ্রীনগর থেকে রাজ্য (আজ কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল) পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব। জম্মুর নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এই সিদ্ধান্তে। বাধ্য হয়ে জম্মুকে ফের রাজধানী হিসাবে মান্যতা দেন ফারুক।
তবে, ছ’মাস অন্তর দরবার স্থানান্তরিত করা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তোলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
প্রশ্ন এক, শ্রীনগর বিশ্বের সবচেয়ে শীতলতম রাজধানী এমনটা নয়। শীতকালে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সে সময় রাশিয়া যদি তাদের একমাত্র রাজধানী মস্কো থেকে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাতে পারে, জম্মু-কাশ্মীর নয় কেন?
প্রশ্ন দুই, প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ট্রাকে কাগজ-পত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় সুষ্ঠভাবে রাজ্য (পড়ুন, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল) পরিচালনাও ব্যাহত হয়।
প্রশ্ন তিন, করদাতাদের টাকায় এত বিপুল ব্যয়ে দুটি রাজধানী চালানোর চেয়ে,আজকের যুগে দাঁড়িয়ে উন্নত প্রযুক্তিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে একটি জায়গা রাজধানী করা সম্ভব নয় কেন?
অন্ধ্র প্রদেশে ৩ রাজধানীর বিতর্ক
২০২০ সালে ‘হাই পাওয়ার কমিটির’ সুপারিশ অনুযায়ী ৩টি রাজধানী করার প্রস্তাবে অনুমতি দেন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডি। বিশাখাপত্তনমকে প্রশাসনিক রাজধানী, করনুলকে বিচার বিভাগীয় রাজধানী এবং অমরাবতীকে আইন বিষয়ক রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এই ৩টি শহরই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণই লক্ষ্য ছিল তাঁর।
জগন্মোহনের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা দেখা যায় একাংশ মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে বিরোধিতা করেন অমরাবতীকে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস ক্যাপিটল’ করার জন্য যাঁরা জমি দিয়েছিলেন, সে সব জমিদাতারা। তাঁদের দাবি, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুকে রাজধানী অমরাবতীর উন্নয়নের জন্য জমি দেওয়া হয়েছিল, এখন রাজ্যে তিনটি রাজধানী করার সিদ্ধান্ত মানে তাঁদের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। অমরাবতীকেই একমাত্র রাজধানী হিসাবে দেখতে চান তাঁরা। তা নিয়ে মামলাও চলছে আদালতে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করছেন, যেখানে একটি রাজ্যের একাধিক রাজধানী হওয়া নিয়ে এত জটিলতা তৈরি হয়, সেখানে এতবড় দেশে চার-চারটি রাজধানী করা মোটেই সহজ কাজ নয়। আর সবথেকে বড় প্রশ্ন, এই কাজটি করতে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবেই বা কে আর বাঁধলে তা কি সত্যিই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন কাজ হবে?