
প্রকৃত বন্ধু কে—এই প্রশ্নের উত্তর বহু আগেই দিয়ে গিয়েছেন মহামতি চাণক্য। তাঁর মতে, উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে কিংবা যুদ্ধের সময় যিনি পাশে থাকেন, তিনিই প্রকৃত বন্ধু। বন্ধুত্বের এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট সংজ্ঞা আর হয় না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কূটনীতির দুনিয়ায় কি এই সংজ্ঞা খাটে?
বর্তমানে ভারতের বন্ধু হওয়ার দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে হুড়োহুড়ি চলছে, তাতেই বিষয়টি জটিল হয়ে উঠছে। আমেরিকা স্পষ্ট দাবি করছে, তারাই ভারতের প্রকৃত বন্ধু। ওয়াশিংটনের বক্তব্য, ভারতের উচিত চিনের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর কড়া নজর রাখা। সীমান্ত সংঘাত নিয়ে চিন যে আলোচনার কথা বলছে, তা নেহাতই চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা। আসল লক্ষ্য, এলএসি-তে ভারতকে দুর্বল করা।
আমেরিকার দাবি আরও গুরুতর। তাদের মতে, চিন চায় ভারতকে বন্ধুহীন করতে। কয়েক বছরের মধ্যেই অরুণাচল প্রদেশ দখলের চেষ্টায় নামতে পারে চিন। সেই লক্ষ্যেই পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) নাকি পরিকল্পনা তৈরি করছে। অর্থাৎ, ভারতের হাতে সময় খুব বেশি নেই। এই প্রেক্ষিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের একটি রিপোর্ট। তিন দিন আগে সেই রিপোর্ট পৌঁছেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের টেবিলে। রিপোর্টের একটি পূর্ণ প্যারাগ্রাফ জুড়ে রয়েছে ভারত–চিন সম্পর্ক। সেখানে লাইনে লাইনে ভারতের প্রতি সতর্কবার্তা। স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, চিন তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে ভারতকে ঘিরে ফেলছে।
সব মিলিয়ে আমেরিকা নিজেদের এমনভাবে তুলে ধরছে যেন তারা ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। ওয়াশিংটনের বক্তব্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে ভারতের উচিত আমেরিকার হাত ধরা।
তবে এই বক্তব্যে চুপ থাকেনি বেজিং। চিনা বিদেশমন্ত্রক এবং চিনা প্রেসিডেন্টের দফতর—দুই জায়গা থেকেই কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে। চিনা বিদেশমন্ত্রক সরাসরি আমেরিকাকে আক্রমণ করে বলেছে, এটা আমেরিকার বহু পুরনো খেলা। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিবাদ লাগাতে আমেরিকার জুড়ি নেই। এই কৌশলের মাধ্যমেই তারা নিজেদের দাদাগিরি কায়েম করতে চায়।
চিনা বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র আরও বলেন, ভারত শুধু চিনের প্রতিবেশী নয়, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুই দেশের মধ্যে যে বিশ্বাস ও সম্পর্ক রয়েছে, সেখানে বাইরের কেউ ফাটল ধরাতে পারবে না, এমনই আশাবাদী বার্তা দেয় শি জিনপিং প্রশাসন।
ফলে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে একেবারে উল্টো মেরুতে। একদিকে আমেরিকা ভারতের ‘প্রকৃত বন্ধু’ হওয়ার দাবি করছে, অন্যদিকে চিন বন্ধুত্বের বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু ভারতকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির এই ক্ষমতার লড়াই ভারতের পক্ষে মোটেও সুখকর নয়, এমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। এতে বিপদের আশঙ্কাও কম নয়।
এখন নজর ভারতের বিদেশমন্ত্রকের ভূমিকায়। পরিস্থিতির জটিলতা বুঝে, ভারসাম্য রেখে পা ফেলাই যে ভারতের কূটনৈতিক স্বার্থে সবচেয়ে জরুরি, সেই আশাই রাখছেন ওয়াকিবহাল মহল।