
সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশে চাকরি হারিয়েছেন ২৫,৭৫২ জন। ইএমআই, সন্তানের স্কুলে ফি, সংসারের নিত্য খরচ কোথা থেকে আসবে কেউ আসবে তারা জানে না। আর সামাজিক সম্মানের কথা তো বলাই বাহুল্য। বাংলার শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিকে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের এক আইনজীবী। প্রশ্ন হল, স্কুল সার্ভিস কমিশনের এই বিপুল চাকরি বাতিল হয়েই কি সেই খোলস ছাড়ানোর ইতি! নাকি আরও বড় কোনও ধাক্কা অপেক্ষা করছে!
সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় সামনে আসার পরই সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। আইনজীবীদের একাংশ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এরপর প্রাইমারি নয় তো? কেন এই আশঙ্কা? কেন প্রাথমিকের চাকরি বাতিল হওয়ার প্রশ্ন উঠছে?
৩২,০০০ চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, সেই মামলা এখন ঝুলে হাইকোর্টে
২০২৩ সালে ৩২০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পরে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ সেই নির্দেশ বদল করে। নির্দেশ ছিল, আপাতত কাজ করতে পারবেন ওই শিক্ষকরা। পরে নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে ৩২০০০ শিক্ষককে। সেখানে ব্যর্থ হলে চাকরি চলে যাবে তাঁদের।
পরে সুপ্রিম কোর্টে যায় সেই মামলা। শীর্ষ আদালত হাইকোর্টের সব নির্দেশ খারিজ করে দেয়। ফলে, প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিছুটা স্বস্তি পান। সুপ্রিম নির্দেশে মামলা ফেরে হাইকোর্টে। হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমেন সেন এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে ওঠে সেই মামলা। সম্প্রতি সেই মামলা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বিচারপতি সৌমেন সেন। এখনও সেই মামলা চলছে।
আদতে কত চাকরি প্রশ্নের মুখে? কী বলছেন আইনজীবীরা?
এসএসসি-র নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় ২৫ হাজার ৭২ জনের চাকরি বাতিল হয়েছে। আদালতে গোটা প্যানেলটাই বাতিল হয়েছে। প্রাথমিকের ক্ষেত্রেও যেহেতুন পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে, তাই সে ক্ষেত্রেও প্যানেল বাতিল হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
৩২,০০০ চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেই কারণেই ওই সংখ্যক চাকরি বাতিল হয়েছিল প্রাথমিকভাবে। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম জানিয়েছেন, প্রাথমিকের দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ ও ২০২০-র নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমটিতে নিয়োগ করা হয়েছিল ৪২,৯৪৯ জনকে, দ্বিতীয়টিতে নিয়োগ পান ১৬,৫০০ জন। যদি এসএসসি-র মতো অনুরূপ রায় দেয় আদালত, তাহলে এই দুই প্যানেল নিয়েই আশঙ্কা থাকবে।
২৬,০০০ আর ৩২,০০০- দুই মামলা কি একই রকম?
স্কুল সার্ভিস কমিশনের মামলা মূলত যে অভিযোগগুলি ছিল র্যাঙ্ক জাম্প, সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি। সবথেকে বড় কথা, এসএসসি-র কাছে কোনও ওএমআর শিট বা তার মিরর ইমেজ ছিল না, ফলে যোগ্য-অযোগ্য বিচার করতে পারেনি আদালত। সেই কারণেই গোটা প্যানেল বাতিল করে দেওয়া হয়।
প্রাথমিকের মামলায় কোনও প্যানেলই প্রকাশ পায়নি। ফলে, র্যাঙ্ক জাম্প হয়েছে কি না, বোঝার উপায় নেই। এক্ষেত্রেও পর্ষদের সঙ্গে এসএসসি-র কোনও তফাৎ নেই। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মতো, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কাছেও নেই কোনও ওএমআর শিট। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম জানাচ্ছেন, প্রাথমিকে দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই কোনও প্যানেল প্রকাশ হয়নি। এমনকী আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরও প্যানেল প্রকাশ করা যায়নি। নম্বরের ব্রেকেজ জানা যায়নি। তাই এ ক্ষেত্রেও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
প্রাথমিকের নিয়োগ নিয়ে মূল অভিযোগগুলি কী
১. ২০১৬ ও ২০২০ দুই নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই কোনও প্যানেল প্রকাশ হয়নি। অথচ নিয়োগ হয়েছে। চাকরি প্রার্থীরা নম্বরের ব্রেক আপ জানতে পারেননি। পর্ষদের বক্তব্য, তাদের নিয়মে নাকি নম্বরের ব্রেক আপ প্রকাশ করার কথা নেই। প্রশ্ন উঠছে, পর্ষদ কি তবে নিজের সুবিধামতো আইন বানিয়ে নিয়েছে?
২. পর্ষদের হাতে কোনও ওএমআর শিট নেই। স্ক্যানড কপিও নেই। ২০২০ সালে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ বলেছিল, সাইবার হ্যাকিং হয়েছে। অভিযোগ দায়েরও করা হয়েছে। কিন্তু সেই অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা রাজ্য জানায়নি বলে দাবি আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের। প্রশ্ন উঠছে, এফআইআর-এর নম্বর কত, কোন থানায় এফআইআর হয়েছে!
৩. ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈধতা শেষ হয় ২০১৮ সালে। ২০২২ সালে লিস্ট প্রকাশ করা হয়, ব্রেকেজ সহ। কিন্তু পরের দিনই নোটিস দিয়ে বলা হয় ওই লিস্ট এরর ফ্রি নয় অর্থাৎ ওটি ত্রুটিযুক্ত। তিন বছর কেটে যাওয়ার পরও ত্রুটিমুক্ত লিস্ট প্রকাশ হয়নি।
৪. অভিযোগ, কোনও ইন্টারভিউ না নিয়েই চাকরি দেওয়া হয়েছে, এসএমএস-এ চাকরি হয়েছে, টাকা দিয়ে চাকরি হয়েছে, কাট অব মার্কসের থেকে অনেক কম নম্বর পেয়েও অনেকে চাকরি পেয়েছে। প্যানেল পাবলিশ করা হয়নি, ফলে কে কত নম্বর পেয়েছে বোঝার উপায় নেই।
এই দুই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ২০১৪ সালে টেট পাশ করেছেন। অর্থাৎ প্রায় ১১ বছর কেটে গিয়েছে। যাঁরা বেনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। বছরের পর বছর চলছে সেই আন্দোলন।