কলকাতা: সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে এবার বড়সড় কোপ পড়ল। সরকারের হাতে পুঁজি না থাকার কারণে একাধিক ওষুধকে ‘ব্লক’ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেই স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর। বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের জন্য বছরে বরাদ্দ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। খরচ কমাতে এবার দামী এবং কার্যকর বেশ কিছু ওষুধ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। এর মধ্যে রয়েছে নেফ্রোলজি, ডায়াবেটিস, হেমাটোলজি, মেডিসিন ও ক্যানসারের ওষুধ। আরও অভিযোগ উঠছে, রাজ্যের কোনও হাসপাতাল যাতে সেন্ট্রাল স্টোরের মাধ্যমে দামী ওষুধ কিনতে না পারে তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু জীবদায়ী ওষুধও ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয়েছে। রাশ টানা হয়েছে জোগানে। এর মধ্যে ক্যানসারের কেমোর মেডিসিন, অ্যান্টিবায়োটিকও রয়েছে। সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ অভিযোগ তুলছেন, খরচ বাঁচাতে সস্তার জেনেরিক ওষুধ সরবরাহে নীতি নিয়ে রাজ্য। অন্যদিকে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে সস্তায় আর ওষুধ সরবরাহ করতেও চাইছে না একাধিক সংস্থা। তার জেরে চরম হয়রানির মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
২০১২ সাল থেকে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু ইদানিং কলকাতা মেডিকেল কলেজ, আরজিকর মেডিকেল কলেজ বা এসএসকেএম সর্বত্রই চিকিৎসা করাতে এসে রোগীরা অভিযোগ তুলছেন, মেডিসিনের অ্যান্টিবায়োটিক হোক কিংবা ডায়াবেটিসের ইনসুলিন কোনও দামী ওষুধই পাওয়া যাচ্ছে না। চিকিৎসক ছ’টা লিখে দিলে চারটে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সাশ্রয়নীতি মেনে চলা হচ্ছে। কাউন্টারে যে ফার্মাসিসরা বসছেন, তাঁরা বলছেন সকলকে ওষুধ দিতে হবে। তাই পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে। কারণ জোগানের অভাব রয়েছে। জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল বা ব্লক হাসপাতালগুলিতে এই পরিষেবা আরও শোচনীয় বলেই অভিযোগ উঠছে।
এনআরএস মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করাতে আসা এক রোগী বলেন, “দাঁতের ব্যাথার জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। প্যারাসিটামল, আরেকটা কী ট্যাবলেট দিল। অ্যান্টিবায়োটিকটা পাওয়া গেল না।” আরেক রোগী জানান, তিন মাস ধরে একটা ওষুধের জন্য ঘুরছেন। এদিকে ওষুধের দামও অনেক বেশি।
চিকিৎসক সংগঠনের নেতা সজল বিশ্বাস বলেন, “আগে ওষুধের যে পরিমাণ বরাদ্দ ছিল, এখন তা অনেকটাই কমানো হয়েছে। সেটা সমস্ত স্তরেই কমানো হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তো কমানোর পরিমাণটা অনেকটাই। মেডিকেল কলেজেও কিডনির ওষুধ, কেমোর ওষুধ সেগুলিও কমানো হয়েছে। এই কমানোর কারণ হিসাবে পয়সা নেই দেখানো হচ্ছে। এদিকে আবার রাজ্য বলছে মানুষকে নিখরচায় চিকিৎসা দিচ্ছি। এতো চূড়ান্ত দ্বিচারিতা। মানুষের সঙ্গে এটা প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। ওষুধের দাম অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বাড়ছে। সরকার তা নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনও চেষ্টাও করে না। এদিকে হাসপাতালে ওষুধ না পেলে সবাই যে বাইরে থেকে দাম দিয়ে কিনবেন সে সামর্থ্যও সকলের নেই। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মানুষকে মরতে হবে। ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির দিকে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা বলছেন, টাকার অপচয় বাঁচাতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় দামী ওষুধ বন্ধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, একই রোগের চিকিৎসাতে একাধিক মলিকিউলের ওষুধ থাকে। দামী মলিকিউল কমিয়ে তুলনামূলক কম দামের ওষুধ রাখা হয়েছে। তাতে ওষুধের কার্যকারিতা মোটেই কমেনি। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, ওষুধ অমিলের কারণ অন্য। কিছু ক্ষেত্রে কাঁচা মালের দাম বাড়ায় পুরনো দরে ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না বেসরকারি সংস্থাগুলি।
ডায়াবেটিসের দু’টি ওষুধ এতদিন সরবরাহ করা হতো সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর থেকে। লিনাগ্লিপটিন ও ভিলডাগ্লিপটিন ওষুধ সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের তালিকায় ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই কলকাতা পুর এলাকার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। কারণ নিয়মিত ওষুধ দু’টি স্টোর থেকে পুরসভার ডায়াবেটিক ক্লিনিকে যেত। সমস্যা সমাধানে পুরসভার মেডিসিন কমিটির বৈঠকও ডাকা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। সমস্যা মেটাতে তৎপর পুরসভা। দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে বলেও আশ্বাস স্বাস্থ্য দফতরের।
স্বাস্থ্য দফতরের এ ক্ষেত্রে বক্তব্য, লিনাগ্লিপটিন ও ভিলডাগ্লিপটিন দামী ওষুধ। এর তুলনায় একই জেনেরিক সস্তার ওষুধ রয়েছে। তার নাম টেনেলিগ্লিপটিন। তা হলে দামী ওষুধের কী দরকার। এ নিয়ে বিজেপির চিকিৎসক সংগঠনের নেতা অর্চনা মজুমদারের বক্তব্য, “আমি এই রাজ্যের মেডিকেল কলেজ থেকেই পাশ করা ডাক্তার। আমাদের সময় ম্যালিগনেন্ট পেশেন্ট কেমোথেরাপির বিষয় কোনও ক্ষেত্রেই কার্ডের ব্যাপার ছিল না। মানুষ গ্রাম থেকে মানুষ আসত। আমরা ওষুধ লিখতাম, স্টোর থেকে ওষুধ পেত। হাসপাতালে আমরা তাদের দিতাম। এই সরকার ২ টাকার বেড থেকে পেয়িং কেবিন, এখন মাননীয়া সবকিছুই টাকার বিনিময়ে করতে চাইছেন। স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় হাসপাতাল আনতে গিয়ে জামা কেটে প্যান্ট আর প্যান্ট কেটে জামা বানাচ্ছেন। এর মাশুল গুনতে মানুষকে আদুল শরীরে থাকতে হচ্ছে।”
এ বিষয়ে তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা শান্তনু সেন জানান, বিষয়টি ভাল ভাবে খোঁজ নিয়ে তারপরই কোনও মন্তব্য করবেন তিনি।
আরও পড়ুন: Gold smuggling: টোটোর ব্যাটারিতে সোনা পাচারের চেষ্টা! বিএসএফ-র হাতে ধরা পড়ল ব্যক্তি