করোনা কেড়েছে প্রাণ, নেই স্মরজিৎ জানা, ‘অভিভাবকহীন’ লাখ লাখ যৌনকর্মী, শোকজ্ঞাপন মুখ্যমন্ত্রীর

tista roychowdhury |

May 09, 2021 | 7:24 PM

১৯৯৫ সালে ড. স্মরজিৎ জানার হাত ধরেই যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বারের পথ চলা শুরু। সোনাগাছি থেকে কালিঘাট, হাড়কাটাগলি-সহ বিভিন্ন জায়গায় লাখ লাখ যৌনকর্মী আজ স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে থাকেন। কিন্তু, বছর কয়েক আগেও এত 'সুদিন' আসেনি লালবৃত্তে।

করোনা কেড়েছে প্রাণ, নেই স্মরজিৎ জানা, অভিভাবকহীন লাখ লাখ যৌনকর্মী, শোকজ্ঞাপন মুখ্যমন্ত্রীর
প্রয়াত ড. স্মরজিৎ জানা

Follow Us

কলকাতা: শহর কলকাতার লালবৃত্তে তিনি ছিলেন অভিভাবক। সকলের জন্য চিন্তা দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তিনি ড. স্মরজিৎ জানা। সোনাগাছি-সহ কলকাতায় গড়ে ওঠা বেড়ে ওঠা সমস্ত যৌনপল্লি নখদর্পণে ছিল তাঁর। সমাজের চোখে ব্রাত্য, অচ্ছ্যুত ‘রাতপরীদের’ জীবনধারণের সুস্থ মান নির্মাণে স্মরজিৎ ছিলেন অগ্রণী। সমাজের বিরুদ্ধে সমাজের সঙ্গে তাঁর ইহজীবনের লড়াই শেষ হল শনিবার। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন আটষট্টি বছরের ড. স্মরজিৎ জানা। তাঁর প্রয়াণে কণ্ঠভার যৌনকর্মী সংগঠন দু্র্বারের (Durbar Mahila Samanwaya Committee) মহাশ্বেতা কাজলদের।

দুর্বার সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৩ এপ্রিল হালকা সর্দিজ্বর বালিগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন ড. জানা। সেখানে তাঁর কোভিড (COVID19) পরীক্ষা হলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অন্য হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শয্য়া সঙ্কটের জেরে কোনও হাসপাতালেই জায়গা হয়নি। অবশেষে, শ্রীরামপুরেরে শ্রমজীবী কোভিড হাসপাতালে স্বেচ্ছায় ভর্তি হন ড. স্মরজিৎ। অবশেষে শনিবার, সকালে তাঁর মৃত্যু ঘটে। শোকস্তব্ধ দুর্বার।

১৯৯৫ সালে ড. স্মরজিৎ জানার হাত ধরেই যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বারের পথ চলা শুরু। সোনাগাছি থেকে কালিঘাট, হাড়কাটাগলি-সহ বিভিন্ন জায়গায় লাখ লাখ যৌনকর্মী আজ স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে থাকেন। কিন্তু, বছর কয়েক আগেও এত ‘সুদিন’ আসেনি লালবৃত্তে। একদিকে  মালকিনের ভয়ে, অন্যদিকে পুলিশ আর স্থানীয় ‘দাদাদের’ দাপটে রীতিমতো নিজের স্বাস্থ্য তুচ্ছ করেই যৌনকর্মীদের ঘরের চাদর বদলাত ঘণ্টায় ঘণ্টায়। গর্ভনিরোধকের ধারণা তখন আকাশকুসুম। এই পরিস্থিতিতেই হু-এর (WHO) তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করেছিলেন ড. জানা। তিনি বুঝেছিলেন, যৌনকর্মীদের সঠিক মর্যাদা অধিকার দিতে গেলে আগে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা। সংঘবদ্ধ করতে হবে তাঁদের। ১৯৯৫-তেই মোট ১২ জন যৌনকর্মীকে (Prostitute) সঙ্গে নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলতে শুরু করে দুর্বার। ধীরে ধীরে সেই ছাতার তলায় আসে নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সমাজের পিছিয়ে পড়া শবর-মুন্ডা থেকে নাচনীদের জন্য গড়ে ওঠা মানভূম লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র; সুদীর্ঘ এই যাত্রায় সবার মাথার উপরে ছিলেন ড. স্মরজিৎ জানা। ইউনিসেফ (UNICEF)-সহ একাধিক আন্তজার্তিক সংস্থার উপদেষ্টা হয়ে কাজ করেছেন ড. জানা।

‘স্যারের’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কণ্ঠভার দুর্বারের অ্যাডভোকেসি অফিসার মহাশ্বেতা মুখোপাধ্য়ায়ের। বললেন, “স্যর তো বিশেষ এখানে আসতেন না। দুর্বারের জন্যই বাইরে বাইরে থাকতেন।একবার উলুবেড়িয়ার একটি অনুষ্ঠানে আমি ব্যবস্থাপক ছিলাম। সেই সময়ে এই ধরনের যৌনকর্মীদের নিয়ে করা অনুষ্ঠানে বিশেষ কেউ আসতে চাইতেন না। কিন্তু সেইবার এসেছিলেন অনেকে। বেশ কিছু কাউন্সিলর, এমএলএ (MLA), এমপিরা। তারপরেই স্যার আমায় ফোন করে জানান, গোটা পশ্চিমবঙ্গে দুর্বারের হয়ে অ্যাডভাইজারি দায়িত্ব আমার হাতে দেওয়া হবে। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু, স্যার বলেছিলেন, ‘আপনাকে চিনে তবেই দায়িত্ব দিয়েছি।’ সেই দায়িত্ব আজও বইছি। ওঁকে আমাদের আরও দরকার ছিল। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আজ অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে নিজেদের।”

ড. স্মরজিৎ জানার মৃত্য়ুতে শোকজ্ঞাপন করেছেন খোদ মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। টুইট করে তিনি লিখেছেন, “স্মরজিৎ জানার মৃত্যুতে আমি শোকাহত। যৌনকর্মীদের জন্য কোঅপারেটিভ গঠন করে তাঁদের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তৈরি করার পাশাপাশি তাঁদের হাতে পরিচয় পত্রও তুলে দিয়েছিলেন তিনি। যার মাধ্যমে যৌনকর্মীদের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল।। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা।”

উল্লেখ্য, নিত্যদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোভিড সংক্রমণের গ্রাফ। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪ লক্ষ ৩ হাজার ৭৩৮ জন। শুক্রবার এই সংখ্যাটি ছিল ৪ লক্ষ ১ হাজার ৭৮ । গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা সামান্য কমেছে, একদিনে মৃত্যু হযেছে ৪ হাজার ৯২ জনের। এই নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২ কোটি ২২ লক্ষ ৯৬ হাজার ৪১৪। এদের মধ্যে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ৩৭ লক্ষ ৩৬ হাজার ৬৪৮। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার ৪৪৪ জন। এই নিয়ে মোট সুস্থ করোনা রোগীর সংখ্যা হল ১ কোটি ৮৩ লক্ষ ১৭ হাজার ৪০৪। মোট মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ২ লক্ষ ৪২ হাজার ৩৬২-তে।

আরও পড়ুন: করমুক্ত করা হোক কোভিড চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম, অক্সিজেন সিলিন্ডারের! ফের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি মমতার

Next Article