১২ ফুটের পাঁচিলের উপর দু’ ফুটের কাঁটাতার, বিনয়ের বাড়ি যেন কালীঘাটের ‘দুর্গ’
বিনয়ের 'দুর্গ'তে সবসময় নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও শুধু তাদের উপরই গোটা বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্ব ছাড়তে রাজি ছিলেন না তিনি। সে জন্য বাড়িতে ঢোকার মুখে দু'টি গেটের দু'দিক থেকে চারটি সিসি ক্যামেরা সব সময় নজর রাখত।
সুজয় পাল: কয়লা পাচার-কাণ্ডে বিনয় মিশ্রর বাড়িতে তল্লাশি চালানোর আগে গোটা কালীঘাট চত্বরে একাধিকবার রেইকি করেছিল সিবিআই। তাতে ওই এলাকায় একমাত্র ১ নম্বর ধর্মদাস রো’য়ের ছ’তলা বহুতলটিতেই নজর আটকেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের।
কেন? গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ওই চত্বরে এইরকম দু’মানুষ উচ্চতার পাঁচিল ঘেরা বাড়ি বা বহুতল আরেকটি তাঁদের নজরে পড়েনি। শুধু পাঁচিলই নয়। বিনয় মিশ্রর বাড়ির পাঁচিলের উপর আবার দু’ফুটের তারকাটা দেওয়া রয়েছে। সামনেই দু’টি লোহার গেটের উচ্চতাও পাঁচিলের সমান। যেখানে ওই চত্বরে বেশিরভাগ বাড়িতেই পাঁচিল নেই, যাদের আছে তাঁদের খুব বেশি হলে ছ’ফুট, সেখানে ১ নম্বর ধর্মদাস রো’য়ের বাড়িতে প্রায় ১২ ফুটের পাঁচিল কেন? তা প্রথম থেকেই ভাবিয়েছে সিবিআই গোয়েন্দাদের। শুধু তাই নয়। গ্রাউন্ড ফ্লোর সমান ঢাকা দেওয়া পাঁচিল এমনভাবেই দেওয়া হয়েছে যাতে পাশের কোনও বাড়ির ছাদ থেকেও ভিতরে কিছু দেখা না যায়। কিন্তু এত গোপনীয়তা কেন? কী এমন হতো সেখানে? কারা যাতায়াত করতেন বিনয়ের বাড়িতে? খুঁজছে গোয়েন্দারা।
কয়লাপাচার কাণ্ডে বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই বিনয়ের বাড়িতে অভিযান চালায় সিবিআই। সরকারি কাজে কেউ যাতে বাধা দিতে না পারে সেজন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের নিয়ে অভিযান চালানো হয়। প্রায় সাত ঘণ্টা অপারেশনের পর ওই বাড়ি থেকে তিনটি ল্যাপটপ, মোবাইল ও প্রচুর নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বিনয়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপগুলি থেকে তথ্যও উধাও। সেগুলিও উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে দু’টি মোবাইলও হাতে এসেছে তদন্তকারীদের। তবে বিনয়ের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন পাওয়া যায়নি। অন্যভাবে কিছু তথ্য ঘেঁটে সিবিআই জানতে পেরেছে, এক প্রভাবশালী-সহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে থাকা বিনয়ের চ্যাট হিস্ট্রি মুছে ফেলা হয়েছে। সেগুলি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে সিবিআইয়ের টেকনিক্যাল টিম। সাহায্য নেওয়া হচ্ছে সেন্ট্রাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবের। সিবিআই জানতে পেরেছে বিনয় নিজের মোবাইল থেকে এই ধরণের কথোপকথন চালাতেন না। তাঁর এক সাগরেদের ফোন থেকেই সেই সব কথা বলতেন। সেই ফোনটিও উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বিনয়ের ওই বহুতল বাইরে থেকে যেকোনও কর্পোরেট বাড়িকেই হার মানাতে পারে। বাড়িটা পুরোটাই কালো কাঁচে ঢাকা। কোনও বারান্দা বা খোলা জায়গা নেই। অর্থাৎ বাড়ির ভিতরে কে বা কারা আছে, বাইরে থেকে তা বোঝার কোনও উপায় নেই। বৃহস্পতিবার বিনয়ের ওই বাড়িতে সিবিআই অভিযান চলাকালীন প্রতিবেশী এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি জানাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। বলছিলেন, “ওই বাড়িতে পায়ে হেঁটে কাউকে যেতে বা আসতে দেখিনি। তবে প্রায়ই কালো কাঁচ লাগানো কিছু গাড়ি ঢুকতে-বেরতে দেখেছি।”
আরও পড়ুন: সিএএ নিয়ে হঠাৎই সুর নরম শান্তনু ঠাকুরের! নেপথ্যে কি ‘গোপন বৈঠক’
বিনয়ের ‘দুর্গ’তে সবসময় নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও শুধু তাদের উপরই গোটা বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্ব ছাড়তে রাজি ছিলেন না তিনি। সে জন্য বাড়িতে ঢোকার মুখে দু’টি গেটের দু’দিক থেকে চারটি সিসি ক্যামেরা সব সময় নজর রাখত। এখন সিবিআইয়ের কাছে ওই সিসিটিভি ফুটেজ অন্যতম হাতিয়ার। কারণ, বিনয়ের বাড়িতে লালা কিংবা অন্য কোনও প্রভাবশালীর যাতায়াত ছিল কি না জানতে ওই সিসিটিভির ফুটেজ চলমান দলিল। ইতিমধ্যেই সেই ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে খবর।
কয়লা পাচার কাণ্ডের তদন্তে সিবিআই গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, মূল চক্রী অনুপ মাজি ওরফে লালার সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন বিনয়। শুধু তাই নয়, ওই নেতাদের কোটি কোটি টাকার মাসোহারা বিনয়ের মাধ্যমেই পৌঁছে দিতেন লালা। নেতারা কোথায় বেআইনি টাকা বিনিয়োগ করতেন সেটা তাঁর মাধ্যমেই হতো। তাই বিনয় এই মামলায় সিবিআইয়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েই এই ঘটনায় যুক্ত প্রভাবশালীদের কাছে পৌঁছে যেতে চায় সিবিআই।
আরও পড়ুন: ‘মাইনর হার্ট অ্যাটাক’, হাসপাতালে ভর্তি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
যদিও বিনয় এখন দেশ ছাড়া। তাকে ফের নোটিস দিয়ে ৪ জানুয়ারি তলব করা হয়েছে। হাজিরা এড়ালে তার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করবে গোয়েন্দারা। তাতেও তাঁকে নাগালে না পাওয়া গেলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে আনা হবে। সেই রাস্তাও তৈরি রাখছে সিবিআই।