কলকাতা: পাট করা সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চোখ বুজে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ভাবলেই এই ছবিটাই ভেসে উঠবে। এটাই বুদ্ধবাবুর স্টাইল স্টেটমেন্ট। শুধু কি পোশাকে! তা তো নয়। তাঁর চলন-বলনেও সিপিএমের অন্যান্য নেতার থেকেও কোথাও একটা তফাৎ রয়েছে। কোথাও যেন তিনি একটু আলাদা। আপদমস্তক রাজনীতিবিদ হলেও, সম্পূর্ণ রাজনীতির বৃত্তে হয়তো তাঁকে রাখা যায় না। সাদা চুল, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে সিগারেট! রাইটার্স থেকে নন্দন, বুদ্ধবাবুর এইটুকুই অনাড়ম্বর ‘দেখনদারি’ বলা যেতে পারে।
কেমন ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনযাত্রা
ছাত্র-রাজনীতি থেকে উঠে এসেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। গোড়া থেকেই ছিলেন কমিউনিস্ট মানসিকতা সম্পন্ন। হয়তো সেজন্যই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার পরেও তিনি একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তাই পরনের পোশাক থেকে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি- সবটাই ছিল খুব ছিমছাম।
জ্যোতি বসুর ডেপুটি বা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নয়, একেবারে ছাত্র-রাজনীতির সময় থেকেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর সমসাময়িক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী-নেতা, নাট্যকার ও প্রবীণ সাংবাদিক রতন চক্রবর্তীর কথায়, “কোনদিন বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ছিল না। তাঁকে কোনদিন ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কোনও পোশাকে দেখা যায়নি। সবসময় সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। বিদেশ সফরের একটি ছবিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে স্যুট-প্যান্ট পরে দেখা গিয়েছিল। তবে এই পোশাক তাঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না।”
প্রিয় পোশাক
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাদা, ফাইন কাপড়ের ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। আর পায়ে থাকত চামড়ার কালো স্যান্ডল, হাতে কালো চামড়ার বেল্ট ও ছোট গোল ডায়ালের ঘড়ি এবং চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। কাঁধে থাকত একটি ঝোলা ব্যাগ। দলীয় কাজে বা প্রশাসনিক কাজে রাজ্য সফরে বেরোলেও একই পোশাকে দেখা যেত তাঁকে। কেবল উত্তরবঙ্গ বা শীতের জায়গায় সফরের সময় পায়ে স্যান্ডলের বদলে থাকত মোজা এবং কালো পাম সু। আর গলায় জড়ানো থাকত একটি মাফলার।
প্রিয় খাবার
কমিউনিস্ট নেতা ও আদর্শে বিশ্বাসী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বরাবর বাঙা়লি খাবার খেতে পছন্দ করতেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও তাঁর স্বাদের বদল হয়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রিয় খাবার ছিল ভাত আর চিকেন। দুপুরে সাদা ভাত এবং মুরগির মাংসের ঝোল পছন্দ করতেন। আর রাতে পছন্দ করতেন ফ্রায়েড রাইস এবং চিকেন কারি। এর সঙ্গে অবশ্যই থাকত আলুভাজা। তিনি ছোট মাছ নয়, বড় মাছ পছন্দ করতেন। ডিমও তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল।
বাড়িতে হোক বা রাজ্য সফরে বেরিয়েও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্রেকফাস্ট ভাল হতে হবে। অধিকাংশ সময় তিনি পরোটা পছন্দ করতেন। পাউরুটি একেবারে খেতেন না। হাতে তৈরি রুটি বা পরোটা পছন্দ করতেন। খাবারের প্রতি বিশেষ সতর্ক থাকতেন বুদ্ধবাবু। তাই বিরিয়ানি বা অ্যাসিডিটি হয়, এমন খাবার থেকে সর্বদা দূরে থাকতেন। আর মিষ্টির প্রতিও তিনি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন না। তবে শেষ পাতে টক দই খেতেন। আর ফলের মধ্যে তাঁর পছন্দ ছিল আম ও জামরুল। বলা যায়, একেবারে আদ্যোপান্ত বাঙালি ছিলেন এবং বাঙালি খাবার পছন্দ করতেন বুদ্ধবাবু।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সবসময়ের সঙ্গী ছিল চা, কফি। দুধ চা এবং দুধ-কফি পছন্দ করলেও মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষলগ্ন থেকে শারীরিক সমস্যার জন্য তিনি কফি খাওয়া প্রায় ছেড়ে দেন এবং লিকার চা খেতেন। বাড়ির বাইরে সাধারণত কেবল জল খেতে তাঁকে দেখা যেত না। সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকত গ্লুকোজ মেশানো জলের বোতল।
স্বাস্থ্যের প্রতি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা। তাঁর অল্পেতেই ঠান্ডা লাগত, বুকে কফ বসার সমস্যা ছিল। তাই উত্তরবঙ্গ বা ঠান্ডা জায়গায় গেলে অধিকাংশ সময় তিনি ঈষদুষ্ণ জল খেতেন।
সখের সর্বদা সঙ্গী
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্বাস্থ্য সচেতন এবং খাবারের বিষয়ে সতর্ক থাকলেও অত্যধিক ধূমপান করতেন। ছাত্র রাজনীতির সময়কাল থেকেই তিনি ধূমপান করতেন। পরবর্তীতে দামি একটি বিশেষ ব্র্যান্ডেরই সিগারেট খেতেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার পরেও এই অভ্যাস তিনি সম্পূর্ণ ছাড়তে পারেননি। তবে মদের প্রতি তিনি বিশেষ আসক্ত ছিলেন না। আর সর্বত্র যাতায়াতের তাঁর সঙ্গী ছিল সাদা অ্যাম্বাসাডর। বলা যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিল সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি ও সাদা অ্যাম্বাসাডর।
নাট্যকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর প্রভেদ
বাম ছাত্র-রাজনীতি থেকে উঠে আসা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর মধ্যে দলকে পরিচালনা করার ক্ষমতা রয়েছে- একথা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-এর প্রথম সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত। তাই তাঁর হাত ধরে ধীরে-ধীরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হয়ে ওঠেন সিপিআইএম-এর বিশিষ্ট নেতা। তারপর দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন বুদ্ধবাবু। এরপর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যের দায়িত্বভারও নেন তিনি। রাজনীতি থেকে কর্মজীবনে এই বিশাল পরিবর্তন হলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর ব্যক্তিগত জীবন ও মননে বিশেষ কোনও পরিবর্তন আসেনি। বিলাসিতা দূরস্ত, দাম্ভিকতার আঁচও লাগেনি। কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে নাট্যজীবন এবং পরবর্তীতে সাংবাদিক হিসাবে খুব কাছ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখেছিলেন তাঁর সমসাময়িক রতন চক্রবর্তী। তাঁর মতে, “মন্ত্রী হওয়ার পরেও সাধারণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে খুব পৃথক, আচরণগত দিক থেকে সেটা বলা যাবে না। মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে কিছু প্রোটোকল, নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে, সেজন্য সকলের সঙ্গে একটা দূরত্ব হয়ে যায়। কিন্তু, মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে পরিচিতজনদের মধ্যে কোনও দূরত্ব, যেটাকে বলে সুপ্ত দাম্ভিকতা, সেটা কখনও আসেনি।”
সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুরাগী
রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে অবাধ চরাচর ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, নাট্যকার, লেখক এবং আবৃত্তিকার। মন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিত নাটক লেখা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। গণনাটকও লিখেছিলেন। এছাড়া ঘনিষ্ঠ মহলে গুনগুন করতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেও শোনা গিয়েছে। বুদ্ধবাবুর কাঁধে থাকা ঝোলা ব্যাগে সবসময় বই থাকত। তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হলেও বিদেশি সাহিত্য নিয়েও চর্চা করতেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেভাবে নাট্যক্ষেত্রে দেখা না গেলেও বইমেলা থেকে রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আবৃত্তি করতে শোনা গিয়েছে। আবার কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই তিনি চলে যেতেন নন্দন-এ। সেখানে এক বিশেষ কক্ষে বসতেন তিনি। আর তাঁকে ঘিরে থাকতেন কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ। অর্থাৎ রাজনীতি ও প্রশাসনিক কর্ম ব্যস্ততার মধ্যেও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাই তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কদর বেশি দেখা যেত।
বিলাসিতা ও দুর্নীতি
৭-এর দশক থেকে রাজ্য বিধানসভার সদস্য ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তারপর স্বরাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী, উপ-মুখ্যমন্ত্রী থেকে টানা দু-বারের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু, কখনও তাঁর মধ্যে বিলাসিতার ছাপ নজরে পড়েনি। আদ্যোপান্ত সাদামাটা বাঙালি ও কমিউনিস্ট নেতা হিসাবেই জীবনযাপন করতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চোখের চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত কিউবা। তিনি একবার চোখের চিকিৎসা করাতে কিউবায় করাতে গেলেও তারপর রাজ্যেই চিকিৎসা করান। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি বিদেশ সফর করেননি তিনি। সিগারেট এবং বই ছাড়া কোনও ব্যাপারেই বিদেশি বা দামি বিশেষ কিছুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন না। তাই পাম অ্যাভিনিউয়ের সাধারণ বাড়িতেই সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন বুদ্ধবাবু।