কলকাতা: একুশের বিধানসভা ভোটের আবহে বার বার রাজ্যে নির্বাচনী হিংসার অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। সেই অভিযোগ আরও জোরাল হয়েছে ২ মে-এর পর, ভোটের ফল প্রকাশ হতেই। বিজেপির অভিযোগ- লাগাতার খুন, ধর্ষণ, মারধর, লুঠপাট, হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের নেতা-কর্মীদের। পুলিশের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারীরা। এরপরই আদালতে একের পর এক মামলা দায়ের হতে থাকে। সব ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হয়। সে সব মামলার শুনানি যত এগিয়েছে, ততই রাজ্যকে আদালতের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছে। রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দল। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও রিপোর্টে কোণঠাসা করেছে বাংলার আইনশৃঙ্খলাকে। সবদিক নজরে রেখে ১৯ অগস্ট বৃহস্পতিবার সেই মামলার তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। আদালতের পর্যবেক্ষণেই এবার এই তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
নির্বাচনের পর রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় হিংসার অভিযোগ ওঠে। অশান্ত বাংলায় রাজ্য ও রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন আইনজীবী অনিন্দ্যসুন্দর দাস। পাশাপাশি এই ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগ তুলে আদালতে যান আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেয়ালও। এ ছাড়াও আরও দু’টি মামলা দায়ের হয় এ সংক্রান্ত। এই ঘটনায় প্রথম থেকেই বিজেপি অভিযোগ করে এসেছে, পুলিশ অভিযোগ নিতে চাইছে না। হাইকোর্টে ভোট পরবর্তী হিংসা মামলার শুনানিতেও বার বার সে কথা উঠে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দলীয় কর্মীদের উপর তৃণমূল কর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তারও অভিযোগ তোলে গেরুয়া শিবির। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেও এ নিয়ে তারা রিপোর্ট দেয়।
বিজেপি কর্মী অভিজিৎ সরকার ভোট পরবর্তী হিংসার বলি হয়েছেন, এই অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল অভিজিতের দাদা বিশ্বজিৎ সরকার। বিশ্বজিতের আর্জি ছিল, সুপ্রিম কোর্ট স্পেশাল ইনভেন্টিগেশন টিম (SIT) গঠন করে এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিক। কিংবা তদন্তভার দেওয়া হোক সিবিআইকে। একই দাবি ছিল আরেক বিজেপি কর্মী হারাণ অধিকারীর পরিবারেরও। এ নিয়ে রাজ্যের কাছে জবাবও তলব করেছিল সুপ্রিম কোর্ট।
ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে বার বারই আদালতে রাজ্য সরকার দাবি করেছে, যদি কোনও হিংসার ঘটনা ঘটে থাকে সমস্তই নির্বার্চনী আচরণ বিধি বলবৎ থাকাকালীন। অর্থাৎ সে সময় রাজ্য সরকারের হাতে কোনও রকম আইনশৃঙ্খলার ভার ছিল না। সবটাই পরিচালনা করেছে নির্বাচন কমিশন। এই ঘটনায় রাজ্য প্রশাসনের কোনও গাফিলতি নেই বলে দাবি করেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তুষ্ট আদালত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও রাজ্যের লিগ্যাল সার্ভিসের আধিকারিককে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু সেই কমিটির অগ্রগতি নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট হয়নি আদালত। এরপরই যাবতীয় অভিযোগ পর্যবেক্ষণের ভার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা NHRC-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রাজ্য কেবলমাত্র লজিস্টিক সাপোর্ট দেবে বলে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রাজ্যের যে সমস্ত জায়গায় ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগ উঠেছে সে সব জায়গা ঘুরে দেখেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা। গত ২৯ জুন যাদবপুরের কেপিসি হাসপাতাল সংলগ্ন নীলসংঘ এলাকায় গিয়েছিল এরকমই একটি দল। সে দলে ছিলেন সংখ্যালঘু জাতীয় কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আতিফ রশিদও। অভিযোগ, ঘরছাড়া বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের সদস্যরা এলাকায় যান। এরপরই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। স্থানীয় বাসিন্দারা মানবাধিকার কমিশনের সদস্যদের সামনে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দেওয়া শুরু করেন। প্রতিনিধিদের উপর হামলারও অভিযোগ ওঠে। এ নিয়েও শুরু হয় নয়া আইনি জটিলতা।
ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনা নিয়ে হাইকোর্টে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পাতার রিপোর্ট দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। সেখানে অসংখ্য অভিযোগ তোলা হয়। “রাজ্যে আইনের শাসন নেই। শাসকের ইচ্ছাই এখানে আইন”, এমনও রিপোর্টে দাবি করে কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশন। একই সঙ্গে ওই রিপোর্টে তৃণমূলের একাধিক প্রথম সারির নেতা মন্ত্রীকে ‘কুখ্যাত দুষ্কৃতী’ বলেও উল্লেখ করা হয়। তালিকায় নাম রয়েছে বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক-সহ উদয়ন গুহ, পার্থ ভৌমিক, শেখ সুফিয়ানদের। এই রিপোর্টের তীব্র প্রতিবাদ জানায় রাজ্য। পাল্টা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে রাজ্যের শাসকদল। কমিশনের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ তোলে সরকার। রাজ্যের বক্তব্য ছিল, কমিশনের সদস্য রাজীব জৈন এক সময়ে বিজেপির আইটি সেলের দায়িত্বে ছিলেন, আইবি ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন। আতিফ রশিদ এবিভিপির টুইটার হ্যান্ডেল সামলেছেন, তাঁকে বিজেপির টিকিটে দিল্লি পুরসভার নির্বাচনেও লড়তে দেখা গিয়েছে। আরেক জন মহিলা সদস্য, যিনি বিজেপি মহিলা নেত্রী ছিলেন। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, “এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছে মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ দল। মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ দল পক্ষপাতদুষ্ট।”
বিজেপি বারবারই চেয়েছিল ভোট পরবর্তী হিংসার মামলায় তদন্ত ভার নিক সিবিআই। কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনও সে আর্জি জানিয়েছিল তাদের রিপোর্টে। অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টও সে পথেই এগোনোর নির্দেশ দিল। বৃহস্পতিবার আদালত জানিয়ে দিল এই ঘটনার তদন্ত করবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। পাশাপাশি গঠন করা হয়েছে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা SIT। আইপিএস আধিকারিক সুমন বালা সাহু, সৌমেন মিত্র, রণবীর কুমার থাকছেন সিটের আধিকারিক হিসাবে। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নজরদারিতে কাজ করবে সিট। সিবিআইয়ের রিপোর্টের পাশাপাশি সিটও ছ’ সপ্তাহের মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টকে রিপোর্ট জমা দেবে। আরও পড়ুন: জোর ধাক্কা রাজ্য সরকারের! NHRC-র সুপারিশেই সিলমোহর হাইকোর্টের, তদন্ত করবে CBI