সু ম ন ম হা পা ত্র
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলে থাকেন, রাজ্যে একটা সময় ছিল যখন কলেজে ভর্তি আর দুর্নীতি সমার্থক শব্দ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় নাকি কলেজের পিছনের গলিতে ‘দালাল’ ধরতে ঘুরে বেড়াত পুলিশ। ২০১১-১২ সালে অনেক কলেজেই ভর্তি দুর্নীতিতে নাম এসেছিল শাসক দলের ছাত্র সংসদের। এমন অভিযোগ মাঝে মধ্যেই শোনা যায়, বিরোধীদের মুখে। তারপর থেকে ভর্তি দুর্নীতি রুখতে সচেষ্ট হয় প্রশাসন। তবে এখনও বিরোধীরা অভিযোগ করে, কলেজে ভর্তির নামে অশান্তি পাকায় তৃণমূল। এমনও দেখা গিয়েছে, ভর্তি সংক্রান্ত এই অশান্তি রুখতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। ২০১৮ সালের কথা। স্নাতক স্তরের ভর্তি প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দীনবন্ধু অ্যান্ডুজ কলেজ। বেআব্রু হয়েছিল তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষ।
সেই সময় পার্থ বাবু বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “কলেজে এ সব বরদাস্ত করা হবে না। ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের কোনও ভূমিকা থাকবে না। পড়ুয়ারা আসবে, পড়াশোনা করবে, বাড়ি যাবে।” এমনকী টিএমসিপির ওই কলেজের ইউনিটও ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দল। কিন্তু তারপরও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। অগত্যা সেই অপবাদ সরিয়ে ফেলতে এবার উদ্যোগ নিচ্ছে রাজ্য সরকার। এখন কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনেই হবে ভর্তি। কোনও কলেজ পৃথকভাবে ‘অ্যাডমিশন পোর্টাল’ চালাতে পারবে না। বিশ্ববিদ্য়ালয় হিসেবে থাকবে একটি নির্দিষ্ট পোর্টাল। সেখান থেকেই হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কলেজে ভর্তি। তবে সরকারের এই ‘সাধু’ উদ্যোগ নিয়েও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে একাংশের শিক্ষাবিদ ও বিরোধী ছাত্র সংগঠনের। কেউ আবার বলছেন, উদ্যোগটা ভাল কিন্তু ফাঁক রাখা চলবে না।
ধরা যাক কোনও পড়ুয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি কলেজে ভর্তি হতে চান। এতদিনের নিয়মে তাঁকে আবেদন করতে হত সেই কলেজের ওয়েবসাইটে। কিন্তু নতুন এই নিয়মে আবেদন করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর বিশ্ববিদ্য়ালয় ভিত্তিক প্রতি বিষয়ে মেধাতালিকা প্রকাশিত হবে। সেই মেধাতালিকা অনুযায়ী কলেজ পছন্দ করার সুযোগ পাবেন পড়ুয়ারা। এরপর কাউন্সেলিংয়ের ভিত্তিতে সেই কলেজে ভর্তি হতে পারবেন ওই পড়ুয়া।
রাজ্যের এই উদ্যোগকে আপাতত ‘সাধুবাদ’ জানিয়েছেন অধ্যাপকদের সিংহভাগই। তবে, আশঙ্কার কথাও থাকছে। অধ্যাপক দেবাশিস সরকারের কথায়, “এই পদ্ধতিতে যদি ভর্তি প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করা যায়, তাহলে ভর্তির পরও যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে শূন্যপদ থাকে, তা কমানো সম্ভব। আর ভর্তির জন্য যে বিপুল সময় নষ্ট হয়, কেন্দ্রীয় অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তি হলে সেই সময় বাঁচবে।” তবে তাঁর মতে, এই কেন্দ্রীয় ভর্তির পদ্ধতিতে কিছু বিষয় থাকলে আরও ভাল হবে। এক- যাদবপুর,প্রেসিডেন্সি ও সেন্ট জেভিয়ার্সের মতো নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হলে তবেই এই প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। তাহলে পড়ুয়াদের এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে যাওয়ার প্রবণতা কমবে। দুই- এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কোনও কলেজে ভর্তি হওয়া এক পড়ুয়া অন্য কোনও কলেজের জন্য আবেদন না করতে পারেন। শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়়ি বলেন, “কলেজে সাহায্য করার জন্য ইউনিয়ন থাকে। কখনও তারা গরিব পড়ুয়াদের ভর্তির জন্য নিয়ে আসে। তবে সরকারের এই নিয়ম অত্যন্ত সাধু উদ্যোগ। সামনের দিনে সামান্যতম কোনও দুর্নীতি থাকা গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়।”
ভর্তির ক্ষেত্রে কলেজের ছাত্র সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসত। নতুন এই নিয়ম নিয়েও মিষ্টি সুরে সরকারকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি ভারতের ছাত্র ফেডারেশন। এসএফআই রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যের আশঙ্কা এ বার ‘কেন্দ্রীয় দুর্নীতি’ হবে। তিনি বলেন, “সরকার বারবার করেই অনলাইনে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তির কথা বলে এসেছে। কিন্তু অনলাইনে ভর্তির পরেও কীভাবে চুরি করতে হয় তা তৃণমূল শিখিয়েছে।” পাল্টা দিয়েছেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য। তাঁর দাবি, কোনও কালেই তৃণমূল জমানায় দুর্নীতি হয়নি। তৃণাঙ্কুর বলেন, “বিরোধীরা বড় বড় কথা বলছেন। তবে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও অনলাইন পদ্ধতি আনার কথা বলেননি। কথায় কথায় বিরোধীরা ছাত্র সংসদকে দোষ দেয়, কারণ কলেজের পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁদের কোনও সংযোগই নেই।”
আরও পড়ুন : Adhir Chowdhury: ‘বিজনেস সামিটের নামে বেকারদের প্রতারিত করছেন মুখ্যমন্ত্রী’, তোপ অধীরের