প্রদীপ্তকান্তি ঘোষ: বিধানসভায় ভরাডুবির পর থেকে ভুল স্বীকার অব্যাহত সিপিএমের। আগে আড়ালে আবডালে স্বীকারোক্তি পর্ব চলছিল। এ বার নির্বাচনী পর্যালোচনায় সিপিএমের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখিয়েই বিপর্যয়। এখানেই শেষ নয়, সংযুক্ত মোর্চার গঠন আরেকটি মোক্ষম ভুল ছিল বলেই মেনে নিয়েছে সিপিএম। পর্যালোচনায় লেখা হয়েছে, কংগ্রেস ও আইএসএফ-র সঙ্গে জোট করা উচিত হয়নি। আইএসএফ নিজের ধর্মীয় পরিচয় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েই যে এই জোট করা হয়েছিল, তাও মেনে নিয়েছে সিপিএম।
সংযুক্ত মোর্চা কখনই স্থায়ী কাঠামো হতে পারে না। অবশেষে স্বীকার করেছে সিপিএম। পাশাপাশি মুখে যতই বলা হোক না কেন, আইএসএফও মুসলিম তথা সংখ্যালঘু পরিচয় মুছে ফেলতে পারেনি। পার্টির চিঠির ১০ নম্বর পাতায় বলা হয়েছে, কংগ্রেস ও আইএসএফের সঙ্গে আসন সমঝোতাকে সংযুক্ত মোর্চা হিসাবে চিহ্নিত করা ও বিকল্প সরকার গড়ার কথা ভুল ছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যৌথ প্রচার ও লড়াইয়ের প্রয়োজনে বামফ্রন্ট ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক অংশকে নিয়ে এগোতে হবে। আগামী নির্বাচনে বিজেপি ও তৃণমূল বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা অব্যাহত থাকতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই নির্দেশ অনুসরণ করা হয়নি বলে এখন বুঝতে পেরেছে সিপিএম। কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএমের জোট হলেও, কংগ্রেসের সঙ্গে আইএসএফ-র যে কখনই জোট হয়নি, সেটাও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে এ রাজ্যে সংযুক্ত মোর্চার ভবিষ্যৎ যে আর নেই, সেই দেওয়াল লিখন যেন আজকের পরই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
সিপিএমের ভুল স্বীকারের তালিকা এখানেই শেষ হচ্ছে না। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’; পুরনো এই স্লোগানকেই নতুন মোড়কে ব্যবহার করাও যে বুমেরাং হয়েছে, মেনে নিয়েছে আলিমুদ্দিন। নির্বাচনী পর্যালোচনার নবম পাতায় লেখা হয়েছে, এই স্লোগান কৃষি আন্দোলনের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি করেছে। পার্টি চিঠিতে আরও উল্লেখ পেয়েছে, এই স্লোগান ব্যবহার করা “সেই সময়ের জমি অধিগ্রহণের কথা মানুষকে মনে করিয়েছে।”
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বসেছিল সিপিএম। সেখানেই অনুমোদিত হয়েছে এই চিঠি। তাতে নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। কৃষি ও শিল্পের সাযুজ্য রক্ষা করার চিরাচরিত স্লোগানে কোনও লাভ তো হয়নি, উল্টে চাষিদের সঙ্গে সিপিএমের বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেছেন কাস্তে-হাতুড়ি নেতৃত্ব। এ বছর নন্দীগ্রামের ভোট প্রচারে গিয়ে গুলিকাণ্ডের দায় মমতা পরোক্ষে অধিকারী পরিবারের উপর চাপিয়ে দেওয়ার পরও এই নিয়েই জোরকদমে প্রচার চালিয়েছিল সিপিএম। সিঙ্গুরেও জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে শিল্পায়নের পদক্ষেপ কোনও ভুল ছিল না, এটা বোঝানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ তো দূরে থাক, এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন যে দলকে হতে হবে, তা কার্যত কেউই কল্পনা করেননি।
কিন্তু কেন এই স্লোগানের ব্যবহার করা হয়েছিল? এই নিয়েও যুক্তি সাজিয়েছে সিপিএম। দলের বক্তব্য, ভূমি সংস্কার-সহ জন কল্যাণমূলক কাজের নজির ছিল তাদের। এতে সমাজের প্রান্তিক, সংখ্যালঘু, এবং আদিবাসী মানুষের কাছে পৌঁছন যাবে বলে মনে করেছিলেন নেতৃত্ব। কিন্তু এই ভাবনায় গলদ ছিল। এর অন্যতম কারণ, এমন একটা সময় নতুন করে এই প্রচারে শান দেওয়া হয়েছিল যখন গোটা দেশ জুড়ে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ দেখা গিয়েছে। এহেন সময়ে সিপিএমের পুরনো আমলের এই স্লোগান তাদের কৃষক সমাজ থেকেই দূরে ঠেলে দিয়েছে।