
কলকাতা: চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের প্রচার তখন জোরকদমে চলছে। ভোট-ময়দানে সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা। আচমকা সিপিএমের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে এল তাঁর সেই চেনা কণ্ঠস্বর। ‘নমস্কার, কেমন আছেন সবাই?’ শুধু চেনা কণ্ঠস্বর নয়। সাদা দাড়ি, চোখে চশমা। বামেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় তো স্বয়ং তিনি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু, তিনি তো অসুস্থ। অশক্ত শরীর। কীভাবে এই বার্তা রাখলেন। না বুদ্ধদেব নিজ মুখে এই বার্তা দেননি। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(AI)-র সাহায্যে এই ভিডিয়ো তৈরি করেছে সিপিএম। আর এই ভিডিয়োই বলছে, অসুস্থ, অশক্ত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ২০২৪ সালেও বামেদের দিশারি।
২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় বামেরা। এগারোর বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেববাবুও পরাজিত হন। COPD-র সমস্যা ছিল। দীর্ঘদিন পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে বেরোতে পারতেন না। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডে বামেদের সভা। সবাই অপেক্ষা করে আছেন কখন আসবেন বুদ্ধদেব। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আসতে পারবেন কি না, তা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কারণ, ধুলো-বালিতে তাঁর শারীরিক সমস্যা হতে পারে। এতকিছুর পরও সেদিন ব্রিগেডে এসেছিলেন বুদ্ধদেব। তাঁর সাদা অ্যাম্বাসাডর ব্রিগেডে দেখা যেতেই সেদিন কর্মী-সমর্থকদের কোলাহল বুঝিয়ে দিয়েছিল, অসুস্থ হলেও তিনিই মধ্যমণি। ব্রিগেডে দেখা দিয়েই সেদিন চলে যাননি প্রাক্তন মুখ্য়মন্ত্রী। প্রায় ঘণ্টাখানেক নিজের গাড়িতে বসেছিলেন। মঞ্চ থেকে বাম নেতারা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।
বছর দুয়েক পরে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ব্রিগেডে বামেদের সভা। ততদিনে শরীর আরও ভেঙেছে বুদ্ধদেবের। এবার আর শরীর দেয়নি। চেষ্টা করেও ব্রিগেডে আসতে পারেননি। কিন্তু, তাঁর মন যে ব্রিগেডে পড়ে, বার্তা পাঠিয়ে সেকথা জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। নিজের বার্তায় তিনি বলেছিলেন, “এরকম একটা বৃহৎ সমাবেশে যেতে না পারার মানসিক যন্ত্রণা বোঝানো যাবে না। মাঠে ময়দানে কমরেডরা লড়াই করছেন আর আমি শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে গৃহবন্দি। ময়দানে মিটিং চলছে আর আমি গৃহবন্দি যা কোনওদিন কল্পনা করতে পারিনি।”
তারপর কেটে গিয়েছে আরও তিন বছর। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্রিগেডে সভা করেছিল বামেরা। শারীরিক অসুস্থতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সেই সভায় আসতে পারেননি বুদ্ধদেব। কিন্তু, সভার আগের দিন বুদ্ধদেববাবুর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যান মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা। বুদ্ধদেববাবুর বার্তা নিয়ে আসেন। ব্রিগেডে সভা শেষে বাম কর্মী-সমর্থকদের সেই বার্তা পড়ে শোনান মীনাক্ষী। বার্তায় বুদ্ধবাবু বলেন, ‘যেখানে ডাক পড়ে, জীবন মরণ ঝড়ে, আমরা প্রস্তুত। এটাই ডিওয়াইএফআই, ব্রিগেডের সমাবেশ সাফল্যমণ্ডিত হবেই।’ মীনাক্ষী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা পড়ে শোনানোর পরই বাম কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একটা উচ্ছ্বাস ধরা পড়ে।
সেই সভার কয়েকমাস পর লোকসভা নির্বাচনের প্রচার। সেখানে AI ব্যবহার করে বুদ্ধদেববাবুর বার্তা প্রচার করে সিপিএম। শরীর তাঁকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও তিনি যে রাজনীতিতে সক্রিয়, তা বারবার দেখা গিয়েছে। অশক্ত শরীর তাঁকে ‘গৃহবন্দি’ করে রাখলেও বামেদের প্রচারে তিনিই পথপ্রদর্শক। তাঁর বার্তা নিয়ে ময়দানে নেমেছে সিপিএম। বৃহস্পতিবার সকালে সেই দিশারিকে হারাল বামেরা। ব্রিগেডের সভায় তিনি না থাকতে পারলেও তাঁর বার্তা যেত। এবার সেই বার্তাও আর যাবে না…