বিশ্লেষণ: রাজ্যের আমলাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তলব, কতটা এক্তিয়ারভুক্ত!

সুমন মহাপাত্র |

Jun 17, 2021 | 1:48 PM

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, রাজ্য যাতে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছাপিয়ে যেতে না পারে তার জন্য সংবিধানে সেই সংস্থান রয়েছে।

বিশ্লেষণ: রাজ্যের আমলাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তলব, কতটা এক্তিয়ারভুক্ত!
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ

Follow Us

কলকাতা: স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে সেই টানাপড়েনের সাক্ষী বাংলাও। কিন্তু রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব এবং ডিজিপিকে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের (Home ministry) তলব করা বেনজির ঘটনা বলেই মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

বাংলার ক্ষেত্রে তো বটেই, দেশের অন্য কোনও রাজ্যেও এ রকম নজির মনে করতে পারছেন না সংবিধান বিশেষজ্ঞ বর্ষীয়ান আইনজীবীরা। বৃহস্পতিবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার কনভয়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটার পরেই শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে রাজ্যের এই দুই শীর্ষ আমলাকে তলব করা হয়। এই তলব করা অসাংবিধানিক নয় বলে একমত প্রায় সকলেই। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে নিয়ে আলাদা আলাদা মত রাজ্যের বর্ষীয়ান আইনজীবীদের।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, রাজ্য যাতে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছাপিয়ে যেতে না পারে তার জন্য সংবিধানে সেই সংস্থান রয়েছে। সংবিধানের ২৫৭ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে কেন্দ্র রাজ্যের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। অশোক বাবুর কথায় দু’জন আমলাকে তলব করা এমন কিছু বড় বিষয় নয়। এর মধ্যে কোনও অস্বাভাকিকত্বও নেই।

তবে অন্য় মত রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রের। তিনি বলেন, “এটা ঠিক যে সংবিধান অনুযায়ী এটা বেআইনি নয়।” তবে, তাঁর ব্যাখ্যা, বেআইনি না হলেও, ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রয়েছে। সেই কাঠামো অনুসারে এই ঘটনা নজিরবিহীন। তাঁর কথায়, আইন শৃঙ্খলা সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যে তালিকাভুক্ত এবং রাজ্যের বিষয়। সেরকম কোনও বিষয় নিয়ে এই তলবের ঘটনা খুবই অনভিপ্রেত এবং বেনজির।

ত্রিপুরার প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং কলকাতা হাইকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও গোটা বিষয়টি “বড় ভুল” বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা সবসময়তেই রাজ্যের এক্তিয়ার ভুক্ত বিষয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই বিষয় নিয়ে রাজ্যের দুই শীর্ষ প্রশাসক বা আমলাকে সরাসরি ডেকে কথা বলতে পারে না। তাঁর মতে, যদি বিষয়টি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ দিতে পারতেন। তাঁর কথায়,”এই ভাবে রাজ্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর উপর আঘাত।”

আরও পড়ুন: এক এসএমএসেই প্যান কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত হবে আধার! জানেন কীভাবে?

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “এটা ঠিক এটা বেনজির ঘটনা। রাজ্যের আমলাদের প্রয়োজনে কেন্দ্র তলব করতে পারে, সংবিধানে এমন সংস্থানও আছে ঠিকই। কিন্তু সচরাচর সেটা করা হয় না। এক্ষেত্রে যে করা হল তার দায়টা কিন্তু রাজ্যকে নিতে হবে কারণ এই রাজ্য সরকার সেই সুযোগটা তৈরি করে দিচ্ছে।“ রাজনৈতিক কর্মসূচি চলার ফাঁকে এই নিয়ে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “প্রশাসন প্রশাসনের কথা বলবে।“ ইঙ্গিত স্পষ্ট, তিনি কিঞ্চিৎ এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন বিষয়টিকে।

এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য নিজের প্রতিক্রিয়ায় জানান, কেন্দ্র নজিরবিহীন কাজ করেছে। কেন্দ্র এই ভাবে রাজ্যের শীর্ষ আমলাদের ডেকে পাঠাতে পারে না।

রাজ্যের শীর্ষ আমলাদেরকে এ ভাবে দিল্লিতে তলব করায় কোনও সাংবিধানিক বাধা না থাকলেও, এ রকম ঘটনা নজিরবিহীন নয় কি? এ প্রশ্নের জবাবে প্রায় ফুঁসে উঠছেন রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচাৰ্য| তিনি বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতিটাই তো নজিরবিহীন| একটা সর্বভারতীয় দলের সভাপতি রাজ্যে আসছেন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে। আর আগের রাত থেকে লোকজন জমায়েত করে পুলিসের মদতে তাঁর কনভয়ের উপরে ভয়াবহ হামলা চালানো হচ্ছে, এ রকম কখনও ঘটেছে নাকি! সুতরাং একটা নজিরবিহীন পরিস্থিতিকে রুখতে গেলে আর একটা নজিরবিহীন পদক্ষেপই দরকার|”

কেন্দ্রীয় সরকার এর পরে আর কী করতে পারে, সে নিয়ে অবশ্য মুখ খুলতে চাননি শমীক| তিনি বলেন, “আমলাদের ডেকে পাঠিয়েছে সরকার| ডেকে পাঠিয়ে সরকার কী বলবে বা কী করবে, সেটা সরকার জানে| আমি সে ব্যপারে কিছু বলতে পারব না| আমি দলের কথা বলতে পারি| দল মনে করছে যে, এ রাজ্যে প্রশাসন বলতে আর কিছু নেই| তৃণমূল আর প্রশাসন এক হয়ে গিয়েছে| পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ হয় না| আমরা আক্রান্ত হলে আমাদের অভিযোগ নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টে আমাদের বিরুদ্ধেই এফআইআর হয়| সুতরাং রাজ্যে রাজ্যপাল ছাড়া আর কারও কাছে আমাদের কথা বলার সুযোগ নেই| তাই আমরা রাজ্যপালকে জানিয়েছি। আমরা দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছি| এর পরে তাঁরা কী করবেন, তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেবেন|”

Next Article