গত কয়েক বছরে বার বার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এ সব টানাপোড়েনের শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাম জমানার শেষ মুখ্যমন্ত্রী। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছরে প্রকাশ্য সে ভাবে কথা বলতেন না বুদ্ধবাবু। এমনকি কোভিড অতিমারির পর থেকে বামেদের সভা-মিছিলেও দেখা যায়নি বর্ষীয়ান এই বামপন্থী নেতাকে। তবে সিপিএমের বিভিন্ন সমাবেশে বুদ্ধবাবুর রেকর্ড করা বক্তব্য চালানো হত। সেই কথা শুনেই আন্দাজ করা যেত তাঁর শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দীর্ঘদিনের মন্ত্রী এবং ২ বারের মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে আলোচনা চলেছে রাজ্যরাজনীতিতে। বাম সরকারের মন্ত্রিসভা নিয়ে তাঁর বক্তব্য এক সময় ঝড় তুলেছিল রাজ্য রাজনীতিতে। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিরোধী উদ্দেশ্যে তাঁর কটাক্ষের জন্য সমালোচিতও হয়েছিলেন বিস্তর। বাম জমানায় অবসরের পর রাজ্যের বর্তমান সরকারের কাজকর্ম নিয়েও অনেক কথা শোনা গিয়েছে বুদ্ধবাবুর গলায়। তাঁর প্রয়াণ দিবসে এ রকমই কিছু বক্তব্য স্মরণ করব এই প্রতিবেদনে।
১৯৭৭ সালে প্রথম বার বিধায়ক হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রথম বার বিধায়ক হয়েই তিনি পেয়েছিলেন মন্ত্রিত্বের স্বাদ। এত বছর মন্ত্রী থাকলেও দুর্নীতির দাগ নিজের শ্বেতশুভ্র ইমেজে কখনও লাগতে দেননি তিনি। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এক বার জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, “চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকব না।” এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক হয়েছিলেন বিস্তর। সিপিএমের অন্দরেরও বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। যদিও সময়ের সঙ্গেই দলের সঙ্গে মতানৈক্য মিটে গিয়েছিল। এর পর ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব দেন। তখন থেকেই রাজ্যের শিল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা বার বার উঠে আসে বুদ্ধদেবের মুখে।
বাম আমলে রাজ্যের কৃষিব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু শিল্পের দিক থেকে রাজ্য ছিল পিছিয়ে। রাজ্যের উন্নতি করতে হলে, শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে শিল্পস্থাপন যে আবশ্যক তা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন বুদ্ধদেব। কৃষির প্রতি অবহেলা না দেখিয়েও যে শিল্পের প্রসার সম্ভব বলে মনে করতেন তিনি। তাই রাজ্যে শিল্পস্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, বিরোধীরা বিভিন্ন প্রচার করছে, সে সময় বুদ্ধদেবের বলা একটি কথা এখনও শোনা যায় সিপিএমের অন্দরে। রাজ্যে শিল্প গড়ে তোলার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত।”
২০০৬ সালে বিপুল ব্যবধানে জিতেছিলেন বামফ্রন্ট। বিরোধীরা প্রায় ধুয়ে মুছে গিয়েছিলেন সেই নির্বাচনে। ২৯৪ আসনের বিধানসভায় বামফ্রন্ট পেয়েছিল ২৩৫টি আসন। এর পরের বছরই টাটা ন্যানো কারখানার জন্য হুগলি জেলার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। সে সময় বিরোধীদের তাচ্ছিল্য করে বুদ্ধবাবু যা বলেছিলেন তাতে ক্ষমতার দম্ভ ছিল স্পষ্ট। বিরোধীদের বিরোধিতা নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “আমরা ২৩৫, ওরা ৩০। কী করবে ওরা?” বুদ্ধবাবুর এই মন্তব্য নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল বিস্তর। সিঙ্গুরের নন্দীগ্রামের আন্দোলন ঘিরেও হোঁচট খেয়েছিল তাঁর সরকার। এর পর ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। ২০১১ সালে দীর্ঘ তিন দশকের বাম জমানার অবসান হয়।
ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পরও শিল্পের জন্য একাধিক বার গলা ফাটিয়েছিলেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার বা সিপিএমের সভায় এ বিষয়ে বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। তৃণমূল সরকারের কিছু কাজকর্ম নিয়েও সমালোচনা করেছেন। তৃণমূল সরকারের কাজে রাজ্য পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে বলেও উৎকণ্ঠিত ছিলেন তিনি। শিল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে এক সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। তাঁদের তো কাজ দরকার। রাজ্যে শিল্প না এলে তাঁরা কী করবে? কোথায় যাবে?” এ রাজ্যের ছেলে-মেয়েদের ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়া নিয়েও দুঃখ ছিল তাঁর মনে। ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর এ বিষয়টিও একাধিক বার শোনা গিয়েছে। রাজ্যে শিল্পস্থাপনের প্রসঙ্গেই এ বিষয়টি নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে ব্রিগেড সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব। সেখান থেকেই তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন, “বিজেপি হঠাও দেশ বাঁচাও”, “তৃণমূল হঠাও বাংলা বাঁচাও।” সমাজের মেহনতি শ্রেণির উন্নতি না হলে যে দেশ এগোবে না, সে কথাও বার বার বলতেন তিনি। এ বিষয়ে বুদ্ধবাবু বলতেন, “আমরা চাই শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তের উন্নয়ন। তবেই দেশ এগোতে পারবে।” এই লক্ষ্যে পৌঁছতে বাম নেতা-কর্মীদের লড়াইয়ে নামতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বেঁচে থাকতে তাঁর এই স্বপ্ন কতটা পূরণ হয়েছে তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু বুদ্ধদেবের কথায় লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে, “এ লড়াই লড়তে হবে, এ লড়াই জিততে হবে।”