‘চাটনি’ থেকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি, কেমন কাটল মুকুলের ৪ বছরের পদ্মাবাস?

ঠিক কী ভাবে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড থেকে মোদী-শাহের ভরসার সৈনিক হয়ে উঠলেন তিনি? তারপরই বা কী ভাবে বিজেপিতে কোণঠাসা হয়ে আগের দলে ফিরে আসা? রইল শেষ ৭ বছরের ঘটনাপ্রবাহের ইতিবৃত্ত...

'চাটনি' থেকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি, কেমন কাটল মুকুলের ৪ বছরের পদ্মাবাস?
ফাইল ছবি
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 12, 2021 | 12:07 PM

কলকাতা: সালটা ২০১৫। পশ্চিমবঙ্গে এসে তৎকালীন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়কে বিঁধতে নতুন স্লোগান শুরু করেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিং। সেটা ছিল- ‘ভাগ মুকুল ভাগ’। সারদা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোর পর সিদ্ধার্থনাথের সেই স্লোগান বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বঙ্গ রাজনীতিতে। কিন্তু সেই মুকুল রায়কেই ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর বুকে টেনে নেয় বিজেপি। দিল্লির দরবারে গিয়ে পদ্মশিবিরে যোগদান করেন তিনি।

শুধু তো তিনি নিজে বিজেপিতে যাননি, বরং একের পর এক তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঘাসফুলকে ভেঙে রীতিমতো খানখান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু, বিজেপিতে গিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলেও পায়ের তলার মাটিটা ঠিক শক্ত করে উঠতে পারেননি মুকুল। বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি পদ পেয়েছিলেন। কিন্তু যে নেতা নিজের সাংগঠিক দক্ষতার জন্য পরিচিত, তাঁকে একুশের বিধানসভা ভোটে সেভাবে ব্যবহারও করেনি বিজেপি। ‘আটকে’ রাখা হয়েছিল কেবল কৃষ্ণনগর উত্তর আসনেই। কিন্তু যেভাবে ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ থেকে তাঁর বিজেপিতে যোগদান হয়, এবং আজ ঠিক যে কায়দায় তিনি তৃণমূলে ফিরছেন, তা বঙ্গ রাজনীতিতে কার্যত নজিরবিহীন হয়ে থাকল বলা চলে।

Mukul Roy

গ্রাফিক্স- অভিজিৎ বিশ্বাস

কিন্তু, ঠিক কী ভাবে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড থেকে মোদী-শাহের ভরসার সৈনিক হয়ে উঠলেন তিনি? তারপরই বা কী ভাবে বিজেপিতে কোণঠাসা হয়ে আগের দলে ফিরে আসা? রইল শেষ ৭ বছরের ঘটনাপ্রবাহের ইতিবৃত্ত…

⇒’ভাগ মুকুল ভাগ’ পর্ব

তৃণমূল নেতৃত্বকে এ রাজ্য থেকে ‘ভাগানোর’ স্লোগান দিয়ে বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হন সিদ্ধার্থনাথ। উল্টোদিকে, সেই সময় সারদাকাণ্ডে চাপ বাড়ছিল মুকুলের উপর। তৃণমূলের অন্দরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের জেরে কিছুটা হলেও হতাশ হয়েছিলেন তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ফলে দূরত্ব বাড়তে শুরু হয়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে। একসময় দল থেকে প্রায় আলাদাই করে নেন নিজেকে।

⇒সারদা-নারদার সাঁড়াশি চাপ

এই সবের মাঝে সারদা নারদার জোড়া চাপ আসা শুরু হয় তৃণমূলের নেতার উপর। ২০১৭ সালে একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। চাপ বাড়ে মুকুলের। যদিও বাকি তৃণমূল নেতাদের তুলনায় তদন্তে অনেক বেশি সহযোগিতা করতে দেখা গিয়েছিল মুকুলকে।

⇒বিজেপিতে যোগদান

২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর। বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের হাত ধরে তৃণমূল ছেড়ে সবার প্রথম বিজেপিতে যোগ দেন মুকুল রায়। তাঁর দেখাদেখি তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পথ বেছে নেন একাধিক তৃণমূল নেতা।

⇒শুরতেই ধাক্কা, জোটে ‘চাটনি’ তকমা

বিজেপিতে যোগ দিলেও মুকুল কখনই খুব একটা স্বস্তি পাননি, এ কথা বলাই যায়। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তাঁকে শুরুতেই ‘চাটনি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কোথাও গিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর শামিল হওয়াকে বিজেপি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না। সেই থেকেই দুই ভাগে ভেঙে যায় বিজেপি। আদি এবং নব্য সংঘাতের সূচনা কার্যত তখন থেকেই।

⇒দুই ভোটের গুরুদায়িত্ব, সার্টিফিকেট মোদী-শাহের

মাঝে যদিও দলে বেশ গুরুত্ব বাড়ে মুকুলের। বুথ স্তরে বিজেপির সংগঠনে শান দেন মুকুল। তৃণমূলের মেশিনারি তৃণমূলেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটে বড় সাফল্য পান। বিজেপিকে ২ বিধানসভা আসন থেকে ১৮ আসনে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বও মুকুলকেই দেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা।

⇒সর্বভারতীয় স্তরে পদপ্রাপ্তি

ভোটের পর জল্পনা শুরু হয়েছিল, হয়তো পুনরায় মুকুল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে পারেন মুকুল। কিন্তু সেটা তিনি পাননি। বরং বিজেপিতে বড় পদ পান মুকুল। ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিজেপি সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পদে আসেন তিনি। যদিও, সর্বভারতীয় পদ পেলেও জাতীয় স্তরে তাঁকে তেমন সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে পায়নি রাজনৈতিক মহল।

⇒একুশে নিষ্ক্রিয়, ‘বন্দি’ কৃষ্ণনগরে

বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ভোট রাজনীতির আড়ালে থাকা মুকুলকে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর থেকে প্রার্থী করে বিজেপি। ঠিক এখানেই মুকুল বড় ধাক্কা খান বলে খবর তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে। কারণ, তিনি কখনই প্রত্যক্ষভাবে মাঠে নেমে ভোট রাজনীতি করার মানুষ নন। বরং সর্বদাই সংগঠক হিসেবেই বেশি সাফল্য পেয়েছেন তিনি। তাই ভোটে জিতলেও ততক্ষণে বিজেপি থেকে মন উবে গিয়েছিল মুকুলের।

⇒মমতার গ্রিন সিগন্যাল

ফেরার মঞ্চ তৈরি হয়েই গিয়েছিল। তবে অপেক্ষা ছিল শুধুমাত্র নেত্রীর সম্মতির। গত ৩০ মার্চ নন্দীগ্রামের সভা থেকে সেই সংকেত দিয়ে দেন তৃণমূল সুপ্রিমো। বলেন, “মুকুল শুভেন্দুর মতো অতটা খারাপ নয়।” ব্যাস, সেই থেকেই শুরু হয় জল্পনা। একই সঙ্গে তাঁর তৃণমূলে ফেরার রাস্তা নিজের হাতেই সাফ করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

⇒মুকুল-জায়ার কাছে অভিষেক

এরপর আরেকটু ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে দেখা যায় তৃণমূলকে। মুকুলবাবুর অসুস্থ স্ত্রী-কে দেখতে হাসপাতালে যান তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন শুভ্রাংশু রায়ের সঙ্গে। তখন থেকেই জল্পনা আরও বৃদ্ধি পায়। তবে সব জল্পনায় অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বঙ্গ রাজনীতির ‘চাণক্য’ মুকুল রায় ফিরলেন নিজের পুরনো ঘরে। জোড়া লাগল ঘাসফুলের ভাঙা সংসার।

⇒কোন ভূমিকায় দেখা যেতে পারে মুকুলকে!

একটা সময় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মুকুল রায়। বর্তমানে সেই জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে ঘরে ফেরার পর নেত্রী মুকুলকে কোন পদ দেন সেই নিয়ে জল্পনা উঠেছে তুঙ্গে। সূত্রের খবর, কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়ক পদ ছেড়ে দেবেন মুকুল। তাঁর জায়গায় তৃণমূলের হয়ে লড়তে পারেন মুকুলপুত্র শুভ্রাংশু রায়। অন্যদিকে মুকুলকে সর্বভারতীয় কোনও পদ নেত্রী দিতে পারেন বলেই জল্পনা তীব্র হচ্ছে।