EXPLAINED: পশ্চিমবঙ্গের ৩ জেলায় অ্যাক্টিভ হয়ে গিয়েছে স্লিপার সেল! দু’দিক দিয়ে হামলা চালাবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান?
JMB sleeper cell: সাধারণ মানুষের মতো বিভিন্ন পেশায় কাজ করে স্লিপার সেলের সদস্যরা। যখন উপর থেকে যা নির্দেশ আসে, সেই কাজ করে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্লিপার সেলের সদস্যরা মূলত দু'রকম হয়। প্রথমত, স্লিপার সেলের সেইসব সদস্য, যারা সরাসরি হামলায় যুক্ত হয় না। হয়তো তারা কোনও জঙ্গিকে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তাকে মোবাইলের সিমকার্ড জোগাড় করে দেয়। কিংবা প্রয়োজনে কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...
কেউ কাউকে চেনে না। কিন্তু, নির্দেশ মতো কাজ করে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো সমাজে বাস করে তারা। অক্ষয় কুমারের ‘হলিডে: আ সোলজার ইজ নেভার অফ ডিউটি’ সিনেমায় ‘স্লিপার সেল’-র এই ভূমিকা দেখা গিয়েছে। গোয়েন্দারা বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলির কাছে এই স্লিপার সেলের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সেই স্লিপার সেল নিয়ে এবার চিন্তা বাড়ছে বাংলার। বাংলাদেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সে দেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ(জেএমবি) তাদের স্লিপার সেলের সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলায়। প্রশ্ন উঠছে, হঠাৎ বাংলাদেশে কীভাবে সক্রিয় হয়ে উঠল নিষিদ্ধ সংগঠনগুলি? কতটা চিন্তা বাংলার? কী বলছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা?
গত ৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। তারপর মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলির সক্রিয়তা বেড়েছে বলে জানাচ্ছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা। অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রিপোর্ট দিয়েছে তারা।
জেএমবি-র স্লিপার সেল-
বছর দশেক আগে খাগড়াগড়কাণ্ডে উঠে এসেছিল জেএমবি-র নাম। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর বর্ধমান শহর লাগোয়া খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল। মৃত্য়ু হয় ২ জনের। এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিহারের বুদ্ধগয়ায় বিস্ফোরণেও উঠে আসে জেএমবি-র নাম। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানাচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জেএমবি-সহ সেদেশের নিষিদ্ধ সংগঠনগুলি। পশ্চিমবঙ্গেও নিজেদের স্লিপার সেলকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছে জেএমবি। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, গত কয়েকমাসে এই রাজ্যে ফের সক্রিয় হচ্ছে JMB-র একের পর এক স্লিপার সেল। মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়ার সীমান্ত এলাকায় বাড়ছে সক্রিয়তা। ওপার বাংলা থেকে সক্রিয় মদতে সীমান্তের এই তিনটি জেলায় বাড়ছে এই সক্রিয়তা।
জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র স্লিপার সেল নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন গোয়েন্দারা। জেএমবি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে হরকাতুল জিহাদের(বাংলাদেশ) পুরোনো মডিউলগুলি। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, গোটা পরিকল্পনায় সমন্বয়কের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির জামায়াতে ইসলামি নেতাদের। সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমন্বয়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে।
গোয়েন্দাদের আরও চিন্তা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের জেলে ভেঙে অভিযুক্তদের পালানোর ঘটনায়। গত জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে জেল ভেঙে ফেরার হয় প্রায় ৭০০ অভিযুক্ত। সেই তালিকায় রয়েছে প্রায় ৫৬ জন বন্দি, যারা জঙ্গি নেতা হিসেবে পরিচিত। এর বাইরেও জঙ্গি অভিযোগে ধৃত এবং সাজাপ্রাপ্ত ১৭৪ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে বলে স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের কারা অধিকর্তা। অন্যদিকে, ভারতেও জেএমবি-র কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে ধৃত বেশ কয়েকজন মুক্তি পেয়েছে। সব মিলিয়ে এই রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় আশঙ্কার কারণ দেখছেন গোয়েন্দারা।
কী কাজ স্লিপার সেলের?
অক্ষয় কুমারের ‘হলিডে: আ সোলজার ইজ নেভার অফ ডিউটি’ সিনেমায় ‘স্লিপার সেল’-র ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের মতো বিভিন্ন পেশায় কাজ করে স্লিপার সেলের সদস্যরা। যখন উপর থেকে যা নির্দেশ আসে, সেই কাজ করে তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্লিপার সেলের সদস্যরা মূলত দু’রকম হয়। প্রথমত, স্লিপার সেলের সেইসব সদস্য, যারা সরাসরি হামলায় যুক্ত হয় না। হয়তো তারা কোনও জঙ্গিকে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তাকে মোবাইলের সিমকার্ড জোগাড় করে দেয়। কিংবা প্রয়োজনে কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আবার আর এক ধরনের স্লিপার সেলের সদস্য থাকে, যারা জঙ্গি ট্রেনিং নিয়ে আসে। তারপর সমাজে সাধারণ মানুষের মতো বিভিন্ন পেশায় কাজ করে। কিন্তু, নির্দেশ পেলেই জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত হয়। যেমন, খাগড়াগড়কাণ্ডে ধৃত মতিউর রহমান বোরখা তৈরি করত। খাগড়াগড়কাণ্ডে ধৃত শাহনুর আলম ছিল অসমে জেএমবি স্লিপার সেলের মাথা।
বাংলাদেশে বাড়ছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলির কার্যকলাপ-
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৯টি সংগঠন জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য নিষিদ্ধ। সেই সংগঠনগুলি হল জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ, আনসার উল বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, হরকত উল জিহাদী বাংলাদেশ (হুজি বি), আল্লাহর দল, হিজবুত তাহরীর, শাহাদাত-ই আল-হিকমা এবং জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।
এই সংগঠনগুলির মধ্যে জাগ্রত মুসলিম জনতা থেকে শুরু করে আনসারুল্লা বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহ দল, প্রত্যেকটিই জেএমবি-র অফ শুট হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ জেএমবি বিভিন্ন সময়ে এই সংগঠনগুলি তৈরি করেছে।
মাঝে আল কায়েদাপন্থী জেএমবি-র একটি অংশ আইসিস মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। কিন্তু গোয়েন্দাদের দাবি, বর্তমানে আল কায়েদা (বাংলাদেশ) সংগঠনের ছায়াতে এই সংগঠনগুলি কাজ করছে। এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশে পট পরিবর্তনের পর থেকে পাক গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ থেকে শুরু করে লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হিজবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলি প্রকাশ্যে কাজ করছে। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারিং, মিটিং থেকে শুরু করে সাংবাদিক বৈঠক করছে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলি। সেখান থেকেই গোয়েন্দাদের দাবি, এই সংগঠনগুলি বাংলাদেশে খাতায় কলমে নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তারা প্রকাশ্যে কাজ করছে।
গোয়েন্দারা বলছেন, দিন তিনেক আগে, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, উত্তরবঙ্গের কয়েকটি সীমান্তে বিজিবি সীমান্ত বরাবর ড্রোন উড়িয়েছে। বিজিবি-র দাবি, সীমান্ত সুরক্ষার জন্য ড্রোন ওড়ানো হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দারা বিষয়টির পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছে সেই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে।
গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সার্বিক এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে সামান্য স্বস্তির খবর মিলেছে বাংলাদেশ সেনার অন্দর থেকে। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল শক্তি হিসেবে পাশে থাকা ইসলামিক কট্টরপন্থীদের একটি নথির কথা উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। ওই নথিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান সেনা কর্তাদের বদল প্রয়োজন। ঔপনিবেশিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত সেনা বাহিনীর বিরোধিতা করা হয়েছে ওই নথিতে। পরিবর্তে ইসলামিক সেনা বাহিনী তৈরির নিদান দেওয়া হয়েছে। সেনার ইসলামীকরণ নিয়ে কট্টরপন্থীদের সঙ্গে বিরোধিতার সুর বাড়ছে বাংলাদেশের সেনা কর্তাদের। এই মতানৈক্য অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আপাতত সীমান্তে নজরদারি, সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ইন্টেল ইনপুট বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর নজর রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় সবসময় বাড়তি নজর দিতে হয় ভারতকে। এবার বাংলাদেশ সীমান্তে বাড়তি নজর দিতে হবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ইমনকল্যাণ লাহিড়ি বলেন, “কেন্দ্রকে রিপোর্ট গিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, দুইদিক থেকে ভারতকে আক্রমণ করা হতে পারে। এক পাকিস্তান, দুই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের মদত রয়েছে। একে অস্বীকার করা যাবে না।” ফলে ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন জেএমবি-র মতো সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতেন। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সেই সংগঠনগুলি শক্তি বাড়াচ্ছে। আবার, একদিন আগেই বাংলাদেশ তিসরাই ইনসাফ পার্টির নেতা মিনাজ প্রধান হুঁশিয়ারি দেন, কলকাতা দখল করবেন তাঁরা। তাঁর এই মন্তব্যের জবাব দিয়েছে ভারত। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সবরকম পদক্ষেপ করেছে নয়াদিল্লি। সোমবারই ঢাকায় গিয়েছেন ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি। সেখানে জেএমবি-সহ নিষিদ্ধ সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে ইউনূস প্রশাসন কী পদক্ষেপ করে, সেটাই দেখার।