
কলকাতা: মঙ্গলবারই এসেছিল নমো-বার্তা। বুধবার সেই বার্তাই প্রতিধ্বনীত হল সুকান্ত-মিঠুনদের কণ্ঠে। প্রসঙ্গ- সংখ্যালঘু-প্রীতি। বিজেপির তারকা নেতা মিঠুন চক্রবর্তী বললেন, “বিজেপি কখনই মুসলিম বিরোধী নয়।” আর সেই দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, “বিজেপি সম্পর্কে বছরের পর বছর মুসলিম সম্প্রদায়কে ভুল বোঝানো হয়েছে। বিজেপির ভয় দেখিয়ে তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক করে রাখা হয়েছে। মুসলিমদের ভারতের নাগরিক ভাবেননি কেউ।” যে বিজেপি ‘হিন্দুত্বের রাজনীতি’ করে বলে বিরোধীরা বরাবর অভিযোগ করে এসেছে, সেই বিজেপি-র এমন মুসলিম লাইন ঔৎসুক্য তৈরি করছে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে। জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বার্তা দিয়েছেন মুসলিম সমাজের কাছে পৌঁছতে হবে নীচুতলার কর্মীদের। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলকাগুলিতে যেখানে সংখ্যালঘুদের আধিক্য, সে সব এলাকায় গিয়ে তাঁদের অভাব-অভিযোগ শুনতে হবে কর্মীদের। শিক্ষিত মুসলিম সমাজের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
চব্বিশের নির্বাচন বছর খানেক দেরি। এর আগে বিভিন্ন রাজ্যে দশ-দশটি বিধানসভা নির্বাচন। লোকসভা নির্বাচনের আগে সার্বিক জনমত পেতে মোদী মরিয়াভাবে ঝাঁপানোর টোটকা দেন এ দিন, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। এই টোটকা সমূহেরই অন্যতম সংখ্যালঘুদের মন জয়। তিনি যখন নির্দিষ্টভাবে সীমান্তবর্তী এলাকার কথা উল্লেখ করে মুসলিম সমাজের কাছে পৌঁছনোর কথা বলেছেন। সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ যে অন্যতম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বাংলায় একেবারে তৃণমূল স্তরে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে জনসংযোগে বিজেপির অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হতে পারে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের মন জয় করতে পারলে চব্বিশের ভোট বাক্সেও তার ইতিবাচক ফল মিলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৮টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। তারপরে দু’বছর গেরুয়ার দাপট ক্রমশ বাড়তে থাকে। যার ফল একুশের নির্বাচনে দেখা গিয়েছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে সুকান্তদের ২৫টি আসনের টার্গেটমাত্রা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সূত্রের খবর, যে সব আসনে কম ব্যবধানে বিজেপি হেরে গিয়েছে কিন্তু বিজেপির সংগঠন ভাল, সে সব জায়গায় বঙ্গ নেতাদের ঝাঁপানোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের মন জয়েরও নতুন টাস্ক যুক্ত হয়েছে।
তবে, রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মতে, এ রাজ্যে বিজেপি কতটা সংখ্যালঘুদের মন জয় করতে পারবে, তাতে সংশয় রয়েছে। কারণ, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে যে গেরুয়া শিবিরের যে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে, তা অনেকাংশে ‘হিন্দুত্বের রাজনীতি’র ফলেই। এর সঙ্গে সিএএ-এনআরসি বিতর্কও বড় ফ্যাক্টর হয়েছে। একাধিক বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতারাও ‘হিন্দুত্বকে’ হাতিয়ার করে সুর চড়ান। এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেও শোনা যায়। ৭০-৩০-এর বিতর্কও জোরালভাবে তুলে থেকেন গেরুয়া শিবির কেউ কেউ। একুশের নির্বাচনের আগে এমন আড়াআড়ি ভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কখনও দেখা যায়নি বলেই একাংশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। নির্বাচনের ফলে বিজেপির ভোট শতাংশ এবং আসন বাড়লেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ফের সরকারে আসে তৃণমূল। অনেকেই মনে করেন, বিজেপির ‘হিন্দুত্বের রাজনীতি’ই সংখ্যালঘুদের আস্থা বাড়িয়েছে তৃণমূলের প্রতি। আর এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন না করতে পারাই বিজেপির পরাজয়ের অন্যতম কারণ হয়েছে বলেও মনে করা হয়।
বুধবার বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ অকপটে স্বীকার করেন, ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ বিজেপিকে ভোট দেন না। পাশাপাশি তাঁর এ-ও যুক্তি, মোদীর কাজে তাঁরা খুশি। কিন্তু বিজেপির ভোটার হতে পারেননি। গুজরাটের উদাহরণ দিয়ে দিলীপ ঘোষ বলেন, “সে সব মানুষদের দলের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ভোটার বানাতে হবে। পার্টিকে ব্যাপকভাবে বাড়াতে যেমন গুজরাটে আমরা করেছি।” এ দিন মিঠুন চক্রবর্তীও ঠিক একই যুক্তি দেন। উত্তর প্রদেশ এবং গুজরাটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট পেয়েই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিজেপি। উল্লেখ্য, এবারে গুজরাট নির্বাচনে গত বারের থেকে বেশি সংখ্যালঘু ভোট পেয়েছে বিজেপি। বিশেষ করে মুসলিম মহিলাদের সমর্থন পেয়েছে বলেই বিজেপি দাবি করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আমেদাবাদের দারিয়াপুর আসনটিও দুই দুইবার বিজেপি নিজেদের দখলে রেখেছে শুধুমাত্র মুসলিম ভোট পেয়েই। উত্তর প্রদেশেও এমন একাধিক উদাহরণ রয়েছে।
এখন প্রশ্ন, সংখ্যালঘুদের মন জয় করবেন কীভাবে বঙ্গ বিজেপি নেতারা? ওয়াকিবহালের মতে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছতে বঙ্গ বিজেপি নেতাদের ঝুলিতে থাকতে পারে গুজরাট-উত্তর প্রদেশের রিপোর্ট কার্ড। যে রিপোর্ট কার্ডে উল্লেখ থাকতে পারে, কত শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বিজেপির কাছে রয়েছে। পাশাপাশি, সংখ্যালঘু মহিলাদের মন জয় করতে তাঁদের আস্তিনে থাকতে পারে মোদী সরকারের তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিরোধী আইনের প্রসঙ্গও। সিএএ নিয়ে মুসলিমদের মনে যদি কোনও ভীতি থাকে, তা দূর করতেও সদর্থক প্রচেষ্টা চালাতে পারেন বিজেপি নেতারা। তৃণমূল যেমন রাজ্য সরকারের প্রকল্পগুলির সুবিধা ‘দিদির দূতের’ মাধ্যমে তুলে ধরছে, সংখ্যালঘুদের কাছে বিজেপিও চেষ্টা করবে কেন্দ্রের প্রকল্পগুলি তুলে ধরতে। এখন দেখার এ সব করে বঙ্গ বিজেপির নেতারা কতটা সফল হন ‘মুসলিমদের মন কি বাত’ বুঝতে!