
কলকাতা:ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলনের সময় মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জে খুন হয়ে যান হরগোবিন্দ দাস এবং তাঁর পুত্র চন্দন। মঙ্গলবার সেই খুনের ঘটনায় ১৩ জন দোষীকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা শুনিয়েছে জঙ্গিপুর আদালত। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল, ওয়াকফ বিরোধিতায় জ্বলে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ, তখন হাজারও অশান্তি-হিংসার মাঝে ১২ এপ্রিলের এই খুনের নৃশংসতা সারা রাজ্যকে কাঁপিয়েছিল। তপ্ত হয়েছিল বঙ্গ রাজনীতি। যার আঁচ গিয়ে পড়েছিল জাতীয় স্তরেও। কারা চালিয়েছিল হামলা? সেখানে তদন্তকারীদের হাতে একাধিক তথ্য উঠে আসে। তদন্তকারীদের দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল, ভিন রাজ্য থেকে ভাড়া করে আনা দুষ্কৃতীরা করেছিল তাণ্ডব! কিন্তু এই ১৩ জন!
তদন্তে জানা যায়, এই ১৩ জন (দিলদার নাদাব, আসমাউল নাদাব, ইনজামামুল হক, জিয়াউল হক, ফেকারুল শেখ, আজফারুল শেখ, মনিরুল শেখ, ইকবাল শেখ, নুরুল শেখ, সাবা করিম, হাজরত শেখ, আকবর আলি, ইউসুফ শেখ) যারা বাবা-ছেলেকে বাড়ির অদূরে কুপিয়ে কুপিয়ে খণ্ড খণ্ড করে খুন করেছিল, তারা এলাকারই লোক! তাহলে ওত ভিড়, ওত বহিরাগতর মধ্যে কীভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হল ওই ১৩ জনকে। যেদিন যাবজ্জীবন সাজা শোনায় জঙ্গিপুর আদালত, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সাংবাদিক বৈঠক করেন দক্ষিণবঙ্গে এডিজি আইনশৃঙ্খলা সুপ্রতীম সরকার। তিনি বর্ণনা দেন, ঠিক কোনভাবে কী উপায়ে ওই ১৩ জনকে শনাক্ত করা গেল। এটি বলতে বলতে গিয়েই একটি শব্দবন্ধের কথা উল্লেখ করেন তিনি। ‘গেট প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস’! সামসেরগঞ্জের ঘটনায় যে ধারা যুক্ত করা হয়েছে, এই কেসে সাজা ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় এটি ভারতবর্ষের মধ্যে ‘দ্বিতীয় কনভিকশন’।
প্রশ্ন হল, কী এই গেট প্যাটার্ন?
আমাদের প্রত্যেকের চলার হাঁটার একটা গতি রয়েছে। নির্দিষ্ট ভঙ্গি রয়েছে। কোনও মামলায় আততায়ীর নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি, এই ‘ভঙ্গি’ সন্দেহভাজনের হাবভাব, চলাফেরার ভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়, সেটাকেই গেট প্যাটার্ন বলে। তদন্তকারীরা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেন।
সামসেরগঞ্জের বাবা-ছেলের খুনের তদন্তে নেমে তদন্তকারীরা এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ প্রথম সংগ্রহ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে যাদের ঘটনাস্থলের আশপাশে দেখা গিয়েছে, তাদের চলাফেরা, ঘরের মধ্যে ঢোকা, বেরনোর ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এরপর আরও একাধিক নুমনা পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন যখন ধৃতদের আদালতে পেশ করা হয়, তখন বিচারকের সামনেও গেট প্যাটার্ন অ্যানালিসিস হয়। পুলিশ কর্তা জানান, অভিযুক্তদের সঙ্গে সেই গেট প্যাটার্ন হুবহু মিলে যায়।
এর আগেও কেবল একটি মামলায় ‘গেট প্যাটার্নের’ সাহায্য নেওয়া হয়
তবে এই প্রথমবার নয়, ‘গেট প্যাটার্ন’ পদ্ধতির সাহায্য তদন্তকারীরা এর আগেও একটি মামলায় নিয়েছিলেন। ২০২২ সালে যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন আগন্তুক! শুধু তাই নয়, সকলের অগোচরে রাতভর বাড়ির ভিতরে ঘাপটিও মেরে রইলেন। পরে সকালে নিরাপত্তারক্ষীদের নজরে আসায় শুরু হয়ে যায় শোরগোল। পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ওই ব্যক্তিকে।
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আগন্তুক মামলার মতো একই কায়দায় তদন্ত
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আগন্তুক মামলার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ওই যুবকের নাম হাফিজুল। হাসনাবাদের বাসিন্দা। এই মামলায় তদন্তকারীরা সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেন। কীভাবে পাঁচিল বেয়ে উঠেছিল, পাঁচিল টপকেছিল, সম্পূর্ণ ভঙ্গি পুলিশ নথিভুক্ত করে। এরপর সেটি হাফিজুলের ভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। তদন্তে পুলিশ এটা জানতে পারে হাফিজুল কিছুটা হলেও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।
সামসেরগঞ্জের মামলায় অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এই গেট প্যাটার্নের সাহায্য নেওয়া দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ১০৩(২) নতুন এই ধারা যোগ করা হয়। গণপিটুনিতে মৃত্যুতে নতুন ফৌজদারি ধারা। আর এই ধারাতেই মুর্শিদাবাদে বাবা-ছেলে খুনে ১৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই কেসে সাজা ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় এটি ভারতবর্ষের মধ্যে ‘দ্বিতীয় কনভিকশন’।
পাশাপাশি এই মামলায় ধৃতদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অস্ত্রে লেগে থাকা রক্তের নুমনা সংগ্রহ করেছিলেন তদন্তকারীরা। সেই নমুনা ধৃতদের DNA-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়।