
ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে বৈঠকের ডাক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সেই বৈঠকের ডাক দেওয়া হয়েছে। উপস্থিত রয়েছেন রাজ্য়ের ইমাম ও মোয়াজ্জেমরা। আজ সভা থেকে মমতা কী বার্তা দেন, সেদিকেই তাকিয়ে সব মহল।
মুর্শিদাবাদের অশান্তির ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আরও জানিয়েছেন, যাদের বাড়ি ভেঙেছে, আবাস যোজনায় তাদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে।
সংখ্যালঘুদের মমতা বলেন, “এক বছর পর দিল্লিতে অনেক পরিবর্তন আসবে। আবার নতুন সরকার হবে। যেদিন বিজেপি ক্ষমতা থেকে যাবে, সেদিন জনবিরোধী আইনগুলো বদলাতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
আন্দোলনের বার্তা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “বাংলায় আন্দোলন করে লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চান। দরকার হলে ট্রেনে যান, বিমানে যান। সেখানে প্রতিবাদ জানান। দরকার হলে রাস্তায় থাকবেন। সব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করুন। তৃণমূলের সাংসদরাও সঙ্গে থাকবে। ইন্ডিয়ার সব দলকে অনুরোধ জানাব সঙ্গে থাকতে।”
ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তুলে মমতা বললেন, “খোঁজ নেব বর্ডার এরিয়ায় কাকে কাকে বিএসএফ হাত করেছে। বাচ্চা ছেলেকে ৫-৬ হাজার টাকার বিনিময়ে ইট ছুড়িয়েছে। তদন্ত করব ভাল করে। প্লেনে কারা আসছে? এয়ারপোর্টে এখন পুলিশও থাকে না। আমরা কোনও রিপোর্ট পাই না। ট্রেনে লোক আসছে। কোনও রিপোর্ট আমাদের দেয় না। আমরা সব বুঝি।”
মমতা বলেন, “রামনবমীর দিন অশান্তি করার প্ল্যান ছিল। আপনারা সেটা ভেস্তে দিয়েছেন। তার জন্য ধন্যবাদ। বুদ্ধির সঙ্গে কাজ করুন। তবে প্রত্যেক সমাজে কেউ কেউ গদ্দার থাকে। টাকা নিয়ে নিজে যে ডালই কাটে।”
ইমামমদের বলেন, “কেন রোজা রাখেন, দোয়া করেন? শান্তির জন্য। আপনাদের যদি আন্দোলন করার থাকে, তাহলে ইন্ডোর স্টেডিয়ামে করুন। বাইরে করবেন না। আমরা শান্তি চাই। আমি যতদিন থাকব, ততদিন হিন্দু ভেদাভেদ করতে পারব না। ভাঙড়েও অশান্তি হল। কী দরকার! কেউ কেউ এই সব সুযোগকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করে। আমাদের কেউ করে থাকলেও নিন্দা জানাব। ইমামরা মসজিদ থেকে বলুন, আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে।”
“অনেক হিন্দুরাও ওয়াকফ সম্পত্তি দান করেছে, সামাজিক কাজের জন্য। আপনারা চান রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড ভেঙে যাক। আর কত পাওয়ার চান আপনি। এখন তো আপনাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তারপরও আপনি এই সব করছেন! চন্দ্রবাবু, নীতীশ বাবু তো চুপচাপ বসে আছে। একটু পাওয়ারের জন্য। ওয়াকফ আইন যদি বদলাতে হয়, তাহলে সংবিধানে সংশোধন করলেন না কেন। আপনি চালাকি করেছেন। সংবিধানে সংশোধনী না এনে বিল এনেছেন। কারণ তাহলে দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগত।”
কেন্দ্রীয় সরকারকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, “সৌদি আরবে, দুবাইতে গিয়ে কার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। দেশে একরকম আর বিদেশে আর একরকম। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত। ভোটের সময় বলেন, সবকা সাথ, সবকা বিকাশ। আর ভোটের পর বলেন, যারা ভোট দেবে, আমরা তাদের সঙ্গে আছি।”
মমতা বলেন, “মুসলিম ভাইবোনদের বলব, এই আইনি সংবিধানে যে সম্পত্তির অধিকারের কথা আছে, তা ভেঙেছে। সংবিধানে ১৮ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে সম্পত্তির উপর রাজ্য সরকারের অধিকারের কথা বলা আছে। সেটা রাজ্য বিধানসভার এক্তিয়ারভুক্ত। সেই অধিকারও কেড়ে নিয়েছে এই আইনের মাধ্যমে। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। সবার উপর প্রভাব পড়বে।”
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের উদ্দেশে মমতা বলেন, “আপনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি তো জানতেন। বাংলাদেশ তো রাজ্যের সীমান্তে।”
মমতা বলেন, “আপনি ইউনূসের সঙ্গে গোপন মিটিং করুন। দেশের ভাল হলে খুশি হব। কিন্তু আপনাদের প্ল্যানিংটা কী। কোনও এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে এসে দাঙ্গা করা! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র বলছে, বাংলাদেশের হাত আছে। বিএসএফ তো বর্ডার সামলায়। সেখানে কোনও অধিকার আমার নেই, রাজ্য সরকারের কাছে নেই। আপনি কেন ঢুকতে দিলেন। কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে। আপনারা চান ভেদাভেদ তৈরি করতে।”
মমতা বললেন, “সংবিধানে ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে যে কোনও ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সেই সূত্রে সম্পত্তি অর্জন ও রক্ষণাবেক্ষণের অধিকারও দেওয়া হয়েছে।”
বিজেপির উদ্দেশে বলেন, “আপনি আমার অধিকার কাড়ছেন। রাম-রহিম সবার অধিকার কাড়ছেন।”
অশান্তি নিয়ে মমতা বলেন, “বিজেপির কথায় দয়া করে অশান্তি করবেন না। কেউ অশান্তি করলে কন্ট্রোল করুন।” তাঁর প্রশ্ন, ওয়াকফ আইন পাস করানোর ক্ষেত্রে এত তাড়াহুড়ো করার কী ছিল।
মমতা বলেন, “আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যা বুঝি, বাবাসাহেব আম্বেদকর তফশিলি জাতির হয়েও সংবিধানের ড্রাফ্টিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।” সেই মমতার দাবি, সংবিধান ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।
‘আমি উস্কানিমূলক কথা বলতে আসিনি।’ বললেন মমতা। তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলায় ওয়াকফ আইন রয়েছে ১৯৩৪ সালের। ১৯৫৪-তে জাতীয় ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। আর সম্প্রতি ২০২৫-এ সংশোধনী আইন হল।
মমতা বলেন, “আমার যেমন যে কোনও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অধিকার নেই। তেমন আপনারও অধিকার নেই কারও ব্যক্তিগত বা ধর্মীয় সম্পত্তি অধিকার করা।”
মুর্শিদাবাদের অশান্তি প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “কিছু প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে গণ্ডগোল হয়েছে, সেটা মুর্শিদাবাদ আসন নয়, মালদহের আসন। কংগ্রেসের জেতা আসন। জেতার সময় জিতবে। দাঙ্গা হলে রাস্তায় বেরবে না, এটা আশা করি না। জন প্রতিনিধিদের সঙ্গে থাকতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেস যদি অশান্তি করত, তাহলে তৃণমূলের তিন বিধায়কের বাড়ি আক্রান্ত হত না। পার্টি অফিসও ভাঙা হত না।”
ইদের পর একটি বৈঠক করার কথা আগেই হয়েছিল। ৭ এপ্রিল সময় দেওয়া হয়েছিল। পরে পিছিয়ে ১৬ তারিখ করা হয়। এই বৈঠক আমি ডাকিনি। ইমামরা আমাকে ডেকেছেন। আমরা এসেছি: মমতা।
অশান্তির আগুন এখনও জ্বলছে সামসেরগঞ্জ, ধুলিয়ানে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন মমতা। ইতিমধ্যেই তিনি বার্তা দিয়েছেন, এ রাজ্যে নতুন ওয়াকফ সংশোধনী আইন কার্যকর হবে না। একই কথা বলেছেন ফিরহাদ হাকিমও।