
কলকাতা: দিনটা ছিল শুক্রবার। আগের দিন প্রয়াত হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুক্রবার তাঁর মরদেহ দান করা হবে এনআরএস হাসপাতালে। মিছিল করে দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে শেষ বিদায় জানাতে মিছিলে সামিল অসংখ্য মানুষ। তাঁদের চোখে জল। ঠিক সেই সময় কয়েক কিমি দূরে আরজি কর হাসপাতালে ঘটে গিয়েছে এক নৃশংস ঘটনা। তখনও তেমনভাবে বিষয়টি জানাজানি হয়নি। নিউজ চ্যানেলগুলিতে তখনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শেষযাত্রার ছবি। তবে কয়েকঘণ্টার মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল আরজি করের ঘটনার কথা। তারপর…। সন্তানহারা এক বাবা-মায়ের লড়াই। এমন এক আন্দোলনের জন্ম হল, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেন। এরই মধ্য়ে রাজনৈতিক চাপানউতোরও তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে আরজি করের নৃশংস ঘটনার এক বছর পূর্ণ হল শনিবার। তিলোত্তমাকে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে সঞ্জয় রায়ে নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে নিম্ন আদালত। তবে তিলোত্তমার বাবা-মার বক্তব্য, একা সঞ্জয় রায় হাসপাতালের ভেতরে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাতে পারে না। নিশ্চয় আরও অনেকে জড়িত রয়েছে। তাঁদেরও বিচারের কাঠগড়ায় না তোলা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিন ফিরে দেখা যাক আরজি কর কাণ্ড…
সকালে ফোনটা পেয়েই বুক কেঁপে গিয়েছিল তিলোত্তমার বাবা-মার-
ডিউটি পড়ায় মেয়ে আগের দিন হাসপাতালে ছিলেন। ৯ অগস্ট সকালে আরজি কর হাসপাতাল থেকে ফোনটা এসেছিল। তিলোত্তমার বাবা-মাকে দ্রুত হাসপাতালে আসতে বলা হয়। বুকটা কেঁপে উঠেছিল বাবা-মায়ের। মেয়ের খারাপ কিছু হল না তো। তড়িঘড়ি উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটি থেকে আরজি করের দিকে রওনা দিলেন। আবার এল ফোন। এবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তিলোত্তমার বাবা-মার। পরে তাঁরা জানিয়েছিলেন, ফোনে তাঁদের বলা হয়, তিলোত্তমা আত্মহত্যা করেছেন। একমাত্র মেয়ে বড় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই মেয়ে আত্মহত্যা করল হাসপাতালেই। শরীর-মাথা যেন আর কাজ করছে না বাবা-মায়ের। হাসপাতালে পৌঁছলেন তাঁরা। সেখানে তখন অনেকে। জানা গেল, হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে তিলোত্তমার দেহ উদ্ধার হয়েছে। ওই হাসপাতালেই মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়।
সেইদিন প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ মিছিল করে এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বহু মানুষ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে শেষ বিদায় জানাতে। তারই মধ্যে সামনে আসে আরজি করের এই ঘটনা। এনআরএস হাসপাতাল থেকে আরজি করে এসে পৌঁছন সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। পৌঁছে যান বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালও। ময়নাতদন্তের পরে তিলোত্তমার দেহ নিয়ে শববাহী যান বার হচ্ছিল আরজি কর থেকে। সেই গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য আটকেও দিয়েছিলেন মীনাক্ষীরা। ওইদিন রাতেই পানিহাটি শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তড়িঘড়ি শেষকৃত্য সম্পন্ন করা নিয়ে পরে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার সিভিক ভলান্টিয়ার-
আরজি করে তিলোত্তমার নৃশংস পরিণতির ঘটনার তদন্তে নেমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাতে অবশ্য ক্ষোভ কমেনি। এই নৃশংস ঘটনায় একজন মাত্র জড়িত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।
পদত্যাগ করলেন আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ-
আরজি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছিল। শেষপর্যন্ত তিলোত্তমাকাণ্ডের চার দিনের মাথায় অর্থাৎ ১২ অগস্ট ইস্তফা দেন সন্দীপ। আবার ওইদিনই তিলোত্তমার বাড়িতে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিলোত্তমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেন।
তদন্তভার পেল সিবিআই-
কলকাতা পুলিশের তদন্তে আস্থা নেই তিলোত্তমার বাবা-মার। কলকাতা হাইকোর্টে হল মামলা। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরন্ময় ভট্টাচার্য গত বছরের ১৩ অগস্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন।
নতুন এক আন্দোলনের জন্ম-
সারা রাজ্য দেখল নতুন এক আন্দোলন। তিলোত্তমার নৃশংস পরিণতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন সাধারণ মানুষ। গত বছরের ১৪ অগস্ট রাত দখলের ডাক দেন মহিলারা। কলকাতা-সহ রাজ্যের কোণায় কোণায় রাত দখলে নামলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাতে মোমবাতি। কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকার নিচে নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে সামিল হলেন সাধারণ মানুষ।
কিন্তু, ওই রাতেই আরজি কর হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চলে। কারা হামলা করল? উদ্দেশ্য কী ছিল? প্রমাণ লোপাটের জন্যই আরজি কর হাসপাতালে ভাঙচুর চালানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে জল্পনা ক্রমশ বাড়ে। সেদিনের সেই হামলা নিয়ে প্রশ্ন আজও ওঠে।
আরজি কর কাণ্ডের রেশ সুপ্রিম কোর্টেও-
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ শুধু কলকাতা বা বাংলাতেই থমকে থাকেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও এই নিয়ে প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে। গত বছরের ১৮ অগস্ট আরজি কর কাণ্ডে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বিশেষ বেঞ্চ। ২ দিন পর রাজ্য সরকারের কাছ থেকে স্টেটাস রিপোর্ট তলব করে শীর্ষ আদালত।
আরজি করের নিরাপত্তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছিল। অবশেষে আদালতের নির্দেশে আরজি করের নিরাপত্তায় CISF মোতায়েন করা হয়।
গ্রেফতার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ-
তিলোত্তমাকাণ্ডের ২৫ দিনের মাথায় সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তবে আরজি করে আর্থিক দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। পরদিন কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার বিনীত গোয়েলের ইস্তফার দাবিতে লালবাজার অভিযানের ডাক দেন জুনিয়র ডাক্তাররা।
স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান আন্দোলন শুরু জুনিয়র ডাক্তারদের-
তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে আন্দোলনের ঝাঁঝ আরও বাড়ান জুনিয়র ডাক্তাররা। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র চিকিৎসকরা অবস্থান আন্দোলন শুরু করেন। ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠক ডাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২ দিনই বৈঠক ভেস্তে যায়।
স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনস্থলে মুখ্যমন্ত্রী-
২ দিন নবান্নে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে আচমকা স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনস্থলে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী। ওইদিন সন্ধেতে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যান। বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবি জানান জুনিয়র ডাক্তাররা। প্রশাসন রাজি হয়নি। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকেন জুনিয়র ডাক্তাররা। সেইসময় মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, এক কাপ চা খেয়ে যাও। না, সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ রাখেননি আন্দোলনকারীরা। ফিরে আসেন আন্দোলন মঞ্চে। ওইদিনই সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে সিবিআই।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে অপসারিত বিনীত গোয়েল-
আরজি কর কাণ্ডের পর থেকে বিনীত গোয়েলকে কমিশনার পদ থেকে সরানোর দাবিতে বারবার সরব হয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। অবশেষে ১৬ সেপ্টেম্বর বিনীত গোয়েলকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে অপসারিত করা হয়। তার চারদিন পর স্বাস্থ্যভবনের সামনে থেকে অবস্থান প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তাররা।
ধর্মতলায় অনশন আন্দোলন শুরু জুনিয়র ডাক্তারদের-
একাধিক দাবিতে এবার অনশন আন্দোলন শুরু করলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। গত বছরের ৫ অক্টোবর ধর্মতলায় সেই অনশন আন্দোলন শুরু হয়।
সিবিআই-র প্রথম চার্জশিট-
আরজি কর কাণ্ডের প্রায় ২ মাস পর গত বছরের ৭ অক্টোবর শিয়ালদহ আদালতে প্রথম চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম উল্লেখ করে চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিটে আর কারও নাম উল্লেখ না থাকায় সিবিআই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন মঞ্চে মুখ্যসচিব-
ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে একের পর এক জুনিয়র ডাক্তাররা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে। এই আবহে ১৯ অক্টোবর অনশন মঞ্চে যান মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। মুখ্যসচিবের ফোনে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। তবে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন আন্দোলনকারীরা।
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক জুনিয়র ডাক্তারদের-
এতদিন একাধিকবার বৈঠকের কথা হলেও শেষ মুহূর্তে তা ভেস্তে যায়। ফের যখন মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বসতে চান, তখন নানা জল্পনা শুরু হয়। শেষপর্যন্ত এবারও বৈঠক ভেস্তে যাবে না তো? প্রশ্ন উঠতে থাকে। তবে এবার বৈঠক হয়। ২১ অক্টোবর নবান্নে সেই বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং হয়। ওইদিনই তিলোত্তমার মা-বাবার অনুরোধে অনশন প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তাররা।
সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে চার্জগঠন-
তিলোত্তমাকাণ্ডে ধৃত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে ৪ নভেম্বর চার্জগঠন করা হয়। ১১ নভেম্বর শিয়ালদহ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এদিকে CBI সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিতে না পারায় ধর্ষণ-খুনের মামলায় জামিন পেয়ে যান সন্দীপ ও অভিজিৎ।
সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা-
তিলোত্তমাকাণ্ডে ধৃত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে সিবিআই যে তথ্য প্রমাণ দেয়, তার ভিত্তিতে গত ১৮ জানুয়ারি বিচারক অনির্বাণ দাস সঞ্জয় রায়কে ধর্ষণ, ধর্ষণের জন্য মৃত্যু এবং খুনের ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন। ২ দিন পর ২০ জানুয়ারি সাজা ঘোষণা করেন বিচারক। তিনি সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা দেন।
সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে হাইকোর্টে রাজ্য ও সিবিআই-
নিম্ন আদালতের রায়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানায় রাজ্যের। সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ২১ জানুয়ারি আবেদন জানায়। তার ৩ দিন পর অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি একই আবেদন জানায় সিবিআই। পরে ৭ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের আবেদন খারিজ করে হাইকোর্ট। তবে সিবিআইয়ের আবেদন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গ্রহণ করেছে।
সিভিক ভলান্টিয়ারের আমৃত্যু কারাবাসের সাজা হলেও লড়াই থামেনি তিলোত্তমার বাবা-মার। তাঁদের বক্তব্য, হাসপাতালের ভিতরে এই নৃশংস ঘটনা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। সিবিআইয়ের বিরুদ্ধেও বারবার ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁরা। মেয়েকে হারানোর এক বছরের মাথায় নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছেন তাঁরা। চোয়াল শক্ত করে তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের মেয়ের নৃশংস পরিণতিতে জড়িতদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন তাঁরা। মেয়ের ন্যায়বিচার তাঁরা কতদিনে পান, সেটাই এখন দেখার।