
কলকাতা: শহরের মধ্যে যেন একটা আলাদাই জনপদ! আর সেই জনপদে একচ্ছত্র রাজত্ব এক আলাদা ‘কর্তা’র! সেই জনপদ যেন দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল। যেখানে ভরসন্ধ্যায় রাস্তায় ফেলে যুবককে ফেলে কুপিয়ে খুন কিংবা, হঠাৎই মুড়ি মুড়কির মতো বোমাবাজি, আবার কখনও গুলিবর্ষণ! আবার সেই এলাকাতেই গ্রেফতার একদল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর! পুলিশের খাতাতেও শহরের বাকি অংশে অপরাধের রেখাচিত্র ওঠানামা করলে, আনন্দপুরের এই গুলশন কলোনিতে অপরাধের গ্রাফ সর্বদাই যেন উর্ধ্বমুখী থাকে! আর এই গোটাটাই নেপথ্যে উঠে আসছে একটাই নাম মিনি ফিরোজ! কে এই মিনি ফিরোজ, কীভাবে নিজের রাজত্ব বিস্তার করলেন তিনি, কীভাবে হয়ে ওঠলেন গুলশন কলোনির ত্রাস, এই সবটাই নিয়ে আজকের দ্য ব্রিফিং রুমে আলোচনা করব। সঙ্গে আমি শর্মিষ্ঠা!
মিনি ফিরোজ! নামটা শুনেই খানিকটা ছোটা রাজনের কথা মনে পড়ল না? নাহ, এই ‘ডন’ আলাদাই সিন্ডিকেট রাজ চালাতেন গুলশন কলোনিতে। গত কয়েক বছরে অপরাধের একাধিক ঘটনা ঘটেছে ইএম বাইপাস সংলগ্ন গুলশন কলোনিতে। শহরের পুরপ্রতিনিধিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর চেষ্টার ঘটনার নেপথ্যেও উঠে আসে গুলশন কলোনির নাম। আর তাতে নবতম সংযোজন অস্ত্র হাতে ভরসন্ধ্যায় এলাকায় দুষ্কৃতীদের উন্মত্ত দাপাদাপি, মুড়িমুড়কির মতো বোমাবাজি।
অপরাধের আঁতুড়ঘর গুলশন কলোনি?
আনন্দপুর থানা থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে গুলশন কলোনি। কলকাতা পুরসভার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তগর্ত এই কলোনি ও তার সংলগ্ন মার্টিনপাড়ায়। বিরোধীদের অভিযোগ, এই এলাকায় লক্ষাধিক মানুষের বাস থাকলেও, ভোটারের সংখ্যা মেরেকেটে ২-৩ হাজার। মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষেরই বাস এই এলাকায়। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ভিন রাজ্যের বাসিন্দা! অভিযোগ, এই গুলশন কলোনিতে কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে একের পর এক বেআইনি নির্মাণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আর এটাই যাবতীয় অশান্তির মূলে। কারণ এই বেআইনি নির্মাণ ঘিরেই শুরু হয়েছে সিন্ডিকেট রাজ!
শহরের একের পর এক অপরাধের ঘটনায় বারবার নাম জড়িয়েছে গুলশন কলোনির। এখানকার আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ে আলাদা করে উদ্বিগ্ন লালবাজার। সম্প্রতি লালবাজারে পুলিশকর্তাদের কাছে আনন্দপুর থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক এই কারণে ভর্ৎসিতও হন! তারপরও বদলায়নি পরিস্থিতি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরের থেকেও কলকাতার অবস্থায় ভয়াবহ। ওখানে তো দুপক্ষের গ্যাং, এখানে এক পক্ষের গ্যাং। ওখানকার বাসিন্দাদের নাম কীভাবে উঠল ভোটার লিস্টে, ওখানে যারা থাকে, কারা তারা? ”
মিনি ফিরোজের উত্থান!
হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, এই সিন্ডিকেট রাজ! আর যার নেপথ্যে বারবার উঠে এসেছে এই মিনি ফিরোজের নাম। আসল নাম ফিরোজ খান, বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। সূত্রের খবর, গুলশন কলোনিতে ফিরোজের সাম্রাজ্য আজকের নয়, পালবদলের আগে থেকেই। ২০১০ সাল থেকেই বাড়ে রমরমা। বরবরাই এলাকায় সেই বিধায়েক অনুগত হিসাবেই তাঁর পরিচিতি থেকেছে। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এলাকায় নির্মাণ ব্যবসায় সিন্ডিকেট চালানো থেকে শুরু করে, একাধিক কাজে তাঁর নাম জড়ায়। একাধিক থানায় তার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ থেকে আর্মস কেস, ভয় দেখানো, তোলাবাজি, বেআইনি পার্কিংয়ের কেস রয়েছে।
এলাকার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, বিধায়কের হয়ে কার্যত গোটা এলাকার নিয়ন্ত্রণই ছিল মিনি ফিরোজের হাতে। বিধায়কের ঘনিষ্ঠ থাকার কারণেই পুলিশ টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি। তবে থানায় কেস হয়নি এমনটা নয়। কসবা থানা থেকে আনন্দপুর, তপসিয়া, তিলজলা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগ।
নানা কাজের জন্য রীতিমতো টিম তৈরি করে চালাত কারবার। একটা টিম যেমন সিন্ডিকেট দেখত, তেমনই অন্য টিম দেখত বেআইনি পার্কিং, আবার অন্যদিকে অন্য এক টিম বিদ্যুতের বিষয়গুলি দেখত।
অপরাধের সাম্প্রতিকতম সংযোজন
২০২৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গুলশন কলোনিতে যে গুলিবর্ষণ ও বোমা ছোঁড়ার ঘটনা ঘটে,তাতেও নাম উঠে আসে মিনি ফিরোজের। গোটা ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সামনে আসতেই শহরের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অস্বস্তিতে পড়ে পুলিশ প্রশাসনও এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে ধরা যাচ্ছিল না মূল অভিযুক্ত মিনি ফিরোজকে। অভিযোগ উঠছিল, তিনি নাকি বিধায়ক ঘনিষ্ঠ, তাতেই অধরা তিনি।
এদিকে, পুলিশের খাতায় ফিরোজ ছিলেন ‘ফেরার’ । অথচ সামাজিক মাধ্যমে বারবার সামনে আসছিলেন ফিরোজ। এমনকি কলকাতা পুলিশকে রীতিমতো থ্রেট দিয়েই বলেছিলেন, তাঁর পেটে যদি কেউ লাথি মারেন, তাহলে যে কাজ তিনি এতদিন করেননি, তাই করবেন। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। অভিযোগ ওঠে বিধায়কের হাত নাকি তাঁর মাথায় রয়েছে।
এরই মধ্যে ফিরোজের সঙ্গে কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষের ছবি সামনে আসে, তাতেই আরও ঘৃতাহুতি হয় বিতর্কে। যদিও সুশান্ত ঘোষ ফিরোজকে ‘গুন্ডা’ অ্যাখ্যাই দেন। তাতে আরও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন ফিরোজ। অন্তরালে থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ছাড়েন নিজের ভিডিয়ো বার্তা। বলেন, যদি গুন্ডাই হয়ে থাকেন তিনি, তাহলে নির্বাচনের সময়ে সুশান্ত ঘোষ কেন তাঁর সাহায্য নিতেন?
এদিকে গুলশনের এই ভিডিয়ো বার্তায় বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে পুলিশ। কীভাবে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে সমাজ মাধ্যমে সক্রিয় ফিরোজ? এরই মধ্যে পুলিশ খবর পায়, ফিরোজ় এলাকা ছেড়ে দিল্লিতে পালিয়ে গিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে কলকাতা পুলিশের একটি দল দিল্লিতে হানা দেয়। রবিবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ নয়াদিল্লি রেল স্টেশনের কাছে আজমেরি গেট থেকে গ্রেফতার করা হয় ফিরোজ়কে। কলকাতায় নিয়ে আসা হয় তাঁকে।
জালে ফিরোজ
২০১০ কাট টু ২০২৫! প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ফিরোজ লালবাজারের কর্তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এখন পুলিশের জালে! কিন্তু লালবাজারের কর্তাদেরই একাংশ বলছে, ওই ছোট্ট এলাকায় লক্ষ লক্ষ টাকা উড়ছে, বেআইনি নির্মাণ বন্ধ না করা গেলে, আদৌ কি এই ফিরোজের রাজত্বের পতন ঘটবে? গুলশন কলোনির অপরাধ কমবে? নাকি ফিরোজ ছাড়া পেয়ে রিএন্ট্রি নেবেন নাকি অন্য কোনও ফিরোজের জন্ম হবে? গুলশন-কলোনির ক্লাইমেক্স নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।