কলকাতা: বামশূন্য বিধানসভার ফল স্পষ্ট হতেই ‘সংযুক্ত মোর্চা’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল একাংশের সিপিএম তথা বাম নেতা-কর্মীদের মনে। এরপরেই মনের সেই প্রশ্ন ক্রমশ কণ্ঠে জাগায় জোর। ধর্মনিরপেক্ষ বামদের পক্ষে ‘সাম্প্রদায়িক’ শক্তি আইএসএফ-এর হাত ধরা নিয়ে প্রশ্নবাণে এখনও জর্জরিত হতে হচ্ছে রাজ্যের একদা সাড়ে তিন দশকের শাসক জোটের শীর্ষ নেতৃত্বকে। আর এই আবহেই বামফ্রন্টের ‘বড় শরিক’ সিপিএম-এর মুখপত্র ‘গণশক্তি’-তে রাজ্যের একমাত্র আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির কলাম প্রকাশিত হওয়ায় বিতর্কের আগুনে ঘি পড়ল।
রাজনীতির ময়দানে ঘুরে দাঁড়াতে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকিকে হাতিয়ার করতে চেয়েছিল সিপিএম। কংগ্রেস ও আইএসএফের সঙ্গে জোট তৈরি করেও উল্লেখযোগ্য কিছু করে দেখাতে পারেনি একদা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় থাকা বামেরা। ঘুরে দাঁড়ানো তো দূর, বিধানসভায় শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে বামেদের। মোর্চার মুখরক্ষা করেছেন আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি। আর ভোটের পর পর্যালোচনায় বসতেই বামেদের অন্দরে থেকেই উঠে এসেছে অসন্তোষ। আইএসএফের সঙ্গে জোট ভালো চোখে দেখেননি অনেক বামপন্থী নেতাই। কিছুদিন আগেই মোর্চা ছাড়ার সুর শোনা যায় খোদ ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদের মুখেই। এরপর হঠাৎ সেই নওশাদই কলম ধরলেন সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে। শনিবারের ‘গণশক্তি’-তে নওশাদের কলাম প্রকাশিত হতেই জন্ম নিয়েছে এক তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক, উঠছে প্রশ্নও। এক দিকে যখন তৃণমূলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’য় লেখার জন্য বিতর্কের মুখে পড়েছেন বাম নেতা অনিল বিশ্বাসের মেয়ে অজন্তা বিশ্বাস। অন্যদিকে আবার বামেদের মু্খপত্রে নওশাদের লেখা নিয়েও জস ঘোলা হচ্ছে।
শনিবার সিপিএমের মুখপত্রে কলম ধরেছেন নওশাদ। ‘মানুষ বিধ্বস্ত, চুপ করে থাকব না’, এই শিরোনামে নওশাদের ওই লেখায় ভাঙড়ের বিধায়ক দাবি করেছেন, ২৯৩ জন বিধায়কের সঙ্গে একা লড়ছেন তিনি। অর্থাৎ তৃণমূল ও বিজেপি বিধায়কদেরই নিজের প্রতিপক্ষ বলে চিহ্নিত করেছেন নওশাদ। পাশাপাশি ভাঙড়ের রাজনৈতিক ছবি ও ভাঙড়ের পরিস্থিতি নিয়ে নিজের কিছু ভাবনা বা পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেছেন ভাঙড়ের বিধায়ক তথা বিধানসভায় আইএসএফের একমাত্র প্রতিনিধি। নওশাদ মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভাঙড়বাসীকে মাল্টি স্টোরেজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিমান বসু। সংযুক্ত মোর্চার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। ভাঙড়ে তৃণমূলের সন্ত্রাস চলেছে, এমন অভিযোগ তুলে বিস্তারিত বর্ণনাও দিয়েছেন নওশাদ।
এখন প্রশ্ন হল রাজনৈতিক সমালোচনার ঝড়ে কি কোনও বিশেষ বার্তা দিতে চাইছেন আলিমুদ্দিনের নেতারা? কিছুদিন আগেও আইএসএফ নিয়ে অসন্তোষের কথা শোনা গিয়েছে বাম শিবিরের অন্দরে। আইএসএফকে জোট সঙ্গী করায় সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা গিয়েছে, এমন প্রশ্ন তুলেছে দলেরই একাংশ। দলের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে বলে দাবি তাঁদের। শরিকদের মধ্যেও মাথাচাড়া দিয়েছে অসন্তোষ। ফরওয়ার্ড ব্লক তো কোনও রাখঢাক না করেই মোর্চা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। এই ইস্যুতে শীর্ষ নেতৃত্বের দিকে আঙুল তুলেছেন অনেকেই। ভোটের ফলাফলের পর আইএসএফের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেই দেখা গিয়েছে সিপিএম নেতৃত্বকে। এমনকি এই আবহে নওশাদ সিদ্দিকি দিন কয়েক আগে জোট ছাড়ার হুঁশিয়ারিও দেন। TV9 বাংলাকে নওশাদ জানিয়েছিলেন, মোর্চার অন্দরে যা পরিস্থিতি, তাতে যে কোনও সময় আইএসএফ জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। মোর্চায় তাঁরা যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছেন না বলেই দাবি করেন নওশাদ। শুধু তাই নয়, আইএসএফের একক কর্মসূচির উদ্যোগও নজর কাড়ে রাজনৈতিক মহলের। এ সবের মধ্যেই ‘গণশক্তি’-তে নওশাদের লেখা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাহলে কি অসন্তুষ্ট নেতাদের কোনও বিশেষ বার্তা দেতেই আইএসএফ-কে কাছে টেনে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকতে চাইছেন শীর্ষ সিপিএম নেতৃত্ব?
সম্প্রতি, এককভাবে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় আইএসএফ। আর সেই সমাবেশ নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, তখন নওশাদ বলেছিলেন, ‘সব দলের নিজস্ব কর্মসূচি নেওয়ার ক্ষমতা আছে। প্রত্যেকের স্বকীয়তা আছে। তাই এই কর্মসূচি। এর সঙ্গে মোর্চার ভবিষ্যতকে জড়িয়ে দেওয়া কাল্পনিক চর্চা ছাড়া আর কিছু নয়।’ ভোট পর্ব মিটতেই দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে আইএসএফ নেতৃত্ব। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলির জেলা কমিটি তৈরির কাজও শুরু করেছে তারা। এই আবহে এ দিনের ‘গণশক্তি’-র লেখা কি রাজনৈতিক সমীকরণে বদলের ইঙ্গিত?
উল্লেখ্য, সম্প্রতি তৃণমূলের মুখপাত্র ‘জাগো বাংলা’য় কলম ধরেছেন সিপিএম-এর প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক তথা ‘গণশক্তি’র প্রাক্তন সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের মেয়ে, আর তা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। আজ সেই উত্তর সম্পাদকীয়’র শেষ কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে। রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে অজন্তার সেই লেখায় উঠে এসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। অজন্তার লেখা নিয়ে তোলপাড় চলছে সিপিএম তথা বামেদের অন্দরে। এর মধ্যে সেই সিপিএম-এরই মুখপত্রে নওশাদের কলাম প্রকাশিত হওয়ায় বিতর্ক আরও কয়েক গুণ বাড়ল।’